Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র রক্ষা করছে কারা

Icon

ইয়াংমি কিম

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র রক্ষা করছে কারা

অন্যান্য উন্নত শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র এখনো তরুণ, ১৯৮৭ সালে কর্তৃত্ববাদী থেকে গণতান্ত্রিক শাসনে যার রূপান্তর ঘটেছিল। তবে কোরিয়ার জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও বিশ্বাস ৩ ডিসেম্বর হঠাৎ ভেঙে পড়ে, যখন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল কিছু রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তার এ পদক্ষেপ দেশবাসীকে পুরোপুরি হতবাক করে দিয়েছিল এবং সংসদ-সদস্যরা সামরিক আইন জারি ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে দ্রুত জাতীয় পরিষদে জড়ো হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই রাতে উপস্থিত ১৯০ জন সংসদ-সদস্যের সবাই (মোট ৩০০ জনের মধ্যে) সংসদ ভবনের চারপাশে থাকা স্পেশাল ফোর্সের বেষ্টনীর ভেতরেই তা বাতিলের পক্ষে ভোট দেন।

ফলে প্রেসিডেন্ট ইউন দ্রুত সিদ্ধান্তটি বাতিল করে দেন। প্রেসিডেন্টের অভিশংসনের দাবিতে জাতীয় পরিষদের চারপাশে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় জড়ো হন। প্রেসিডেন্ট ইউনকে তার অভিশংসন শুনানিতে উপস্থিত হতে দেখা গণতন্ত্রের জন্য খুব অন্ধকার দিন বলে মনে হতে পারে; কিন্তু বাস্তবে এসব ঘটনা কোরিয়াবাসীদের আশা জাগিয়ে তুলবে। স্বঘোষিত জনপ্রিয় নেতা ইউন সংখ্যালঘু সরকার ও আইন প্রণয়নে অক্ষমতার কারণে কিছু সময় শাসন করার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তবে ক্ষমতাগ্রহণের পর তার স্ত্রী ফার্স্টলেডি কিম কেওন-হিকে ঘিরে থাকা অন্তহীন সব কেলেঙ্কারি ইউনকে ইতোমধ্যেই অনিশ্চিত অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ুং নামের একজন রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারী, যিনি একটি পোলিং কোম্পানি চালাতেন, সংবাদ মাধ্যমগুলো অভিযোগ করে, সেই সংস্থাটি যাচাই না করেই জরিপের ফল প্রকাশ করেছে এবং অবৈধভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে ফোনকল রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, মিউং ফার্স্টলেডি এবং পিপিপির (পিপল পাওয়ার পার্টি) কিছু প্রার্থীর সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। এ ঘটনা অনেক কোরিয়াবাসীকে ২০১৭ সালের প্রভাব বিস্তারের কেলেঙ্কারির কথাই মনে করিয়ে দেয়, যা পরিস্থিতিকে জাতীয় বিক্ষোভ ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হাইয়ের অভিশংসনের দিকে পরিচালিত করেছিল। যদিও জবাবদিহিতা এবং তার অভিশংসনের দাবিতে বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে ইউন দাবি করেন, তিনি অনুপযুক্ত কিছু করেননি।

এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় অভিযোগ আছে, ইউন ও তার মূল রাজনৈতিক সহযোগীরা, যাদের মধ্যে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ অন্যরাও ছিলেন, চূড়ান্ত রাজনৈতিক খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এ চেষ্টার প্রতিবাদে ডান ও কট্টরপন্থিদের একটি অংশ সিউলের রাস্তায়, সেই সঙ্গে ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হয়েছে। ১৯ জানুয়ারি বিক্ষোভকারীদের একাংশ সিউলের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা আদালতে হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয় এবং সম্পত্তির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়। এ ঘটনায় পর কয়েক ডজন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়। ইউনের সমর্থকদের লক্ষ্য হরো রাজনৈতিক বিতর্ককে উসকে দেওয়া, বিরোধীদলীয় নেতা লি জে-মিয়ুংয়ের নিন্দা করা, যিনি নিজেও নানা কেলেঙ্কারির কারণে তদন্তের মুখে রয়েছেন। এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তহীন রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ও দ্বন্দ্বে ক্লান্ত পিপিপির সদস্যরা সংসদে উপস্থিত হতে বা অভিশংসন সম্পর্কিত মূল ভোটে অংশ নিতে অস্বীকার করে।

এ সবকিছু থেকে বোঝা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। স্পষ্টতই, দেশটির রাজনীতি স্বাস্থ্যকর অবস্থায় নেই। কারণ অসংখ্য রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি স্কুইড গেম থেকে প্যারাসাইট পর্যন্ত কোরিয়ার নাটক ও চলচ্চিত্রেও গভীরভাবে ধরা পড়েছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, দেশটিতে গুরুতর রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, সামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা রাস্তায় বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঝুঁকির কারণে আরও খারাপ হয়েছে।

তবে এসব উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও আশাবাদী হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। গভীর সংকটের সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। প্রথমত, পার্লামেন্ট সদস্যরা অবিলম্বে সামরিক আইন তুলে নেওয়ার জন্য দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে কাজ করেছিলেন, যারা এখনো কর্তৃত্ববাদী সরকার ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বেদনাদায়ক স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিক আদালতের শুনানি চলছে। কারণ রাজনৈতিক কুশীলবরা যা-ই বলুন বা যা-ই চান না কেন, আইনটি বহাল রাখা দরকার। সামরিক আইন জারি করা রাষ্ট্রদ্রোহের কাজ ছিল কিনা, তা তদন্ত করার জন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা গঠিত দুর্নীতি তদন্ত অফিস (সিআইও) অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। ইউনকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হওয়ার প্রথম মামলাটি সিআইওর নিষ্ক্রিয়তার কারণে ছিল না, বরং সে সময় পুলিশ অফিসার, প্রসিকিউটর অফিসের স্টাফ কিংবা ইউনের বাসভবন পাহারা দেওয়া প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা দলের মধ্যে হতাহতের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং প্রেসিডেন্টের বাসভবনের নিরাপত্তা সেবাগুলোর মতো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও উত্তেজনাপূর্ণ অচলাবস্থার মধ্যে স্পষ্ট সংযম বজায় রেখেছে। মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষদের গ্রেফতার করা হলেও মাঝারি ও নিু-পদমর্যাদার আইনপ্রণেতারা আইন সমুন্নত রাখার জন্য তাদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করছেন। সামরিক আইন জারির সময় সৈন্যদের পিতারা তাদের কর্তব্যরত ছেলেদের সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করার জন্য বার্তা পাঠাতেন, যা তাদের ১৯৮০ সালের মে মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম শহর গোয়াংজুতে গণহত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়।

প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন দুর্বোধ্য কিংবা উদাসীন নয় যে, যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তারা কাজ করে, তা থেকে বিচ্ছিন্ন। যারা কাজ করে, তাদের অধিকাংশই দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ মানুষ, তারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও শিক্ষায় অনুপ্রাণিত, যার জন্য তারা গর্বিতও বটে। কাজেই তা রক্ষা করতে তারাও চায়। প্রেসিডেন্টের এহেন পদক্ষেপকে অবজ্ঞা করার জন্য তাদের ধন্যবাদ। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অসাধারণ প্রদর্শনের কারণে দেশটির গণতন্ত্র এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার দিশা দেখাচ্ছে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তরিত

ইয়াংমি কিম : এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; পরিচালক, স্কটিশ সেন্টার ফর কোরিয়ান স্টাডিজ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম