বাংলাদেশের দারিদ্র্যের বাস্তবতা ও উত্তরণের পথ

ড. সায়েদা আখতার বেগম
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৪ পিএম

বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমেছে। তবে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী এখনও দারিদ্র্যের সীমার নিচে বসবাস করছে।
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ধীরে ধীরে কমলেও এর প্রকৃতি বদলে গেছে। খাদ্যনির্ভর দারিদ্র্যের পরিবর্তে এখন দারিদ্র্যের সংজ্ঞা বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে দারিদ্র্য নিরূপণ করা হচ্ছে। দারিদ্র্যের পরিমাপে সাধারণত মাথাপিছু আয় ও পরিবারের আকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যে-সব পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি, তাদের মাথাপিছু আয় কম হওয়ায় দারিদ্র্যের প্রকোপও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
তবে দারিদ্র্যের প্রকৃত চিত্র বোঝার জন্য কেবল আয় নয়, বরং জীবনমানের অন্যান্য সূচক যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, নিরাপদ পানীয় জল, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদিকেও বিবেচনায় নিতে হয়। বর্তমানে দারিদ্র্য নির্ধারণের জন্য বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (MPI) ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে জীবনমানের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে দারিদ্র্যের প্রকোপ নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের কারণ একাধিক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য অন্যতম প্রধান কারণ। সম্পদের অসম বণ্টন, কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং শিক্ষার সুযোগের অভাব দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও পেছনে ঠেলে দেয়।
কৃষি খাত এখনও দেশের বৃহত্তম কর্মসংস্থানের উৎস হলেও এ খাতে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব এবং উৎপাদনশীলতার সীমাবদ্ধতা দরিদ্র কৃষকদের আয় বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করছে। শহরাঞ্চলে চাকরির সুযোগ সীমিত, শ্রমবাজার অনিশ্চিত এবং বস্তি এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ দারিদ্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও বিপদে ফেলে। কৃষিনির্ভর দরিদ্র পরিবারগুলো দুর্যোগের ফলে জমি হারায়, ফসল নষ্ট হয় এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা দারিদ্র্যের আরেকটি প্রধান কারণ। দরিদ্র মানুষেরা সাধারণত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় না, যার ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং আয় কমে যায়। গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রধানত কৃষিনির্ভর। তাদের আয়ের পথ সীমিত, ফলে তারা দারিদ্র্যের চক্রে আটকে থাকে। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষিক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়।
অপরদিকে, শহরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী মূলত বস্তিতে বসবাস করে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন বাংলাদেশের দারিদ্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রাম থেকে শহরে আসার পেছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করে। একদিকে গ্রামে কর্মসংস্থানের অভাব (Push Factor) এবং অন্যদিকে শহরে চাকরির সুযোগ ও উন্নত জীবনের আকর্ষণ (Pull Factor)।
তবে বাস্তবে দেখা যায়, শহরে আসা বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ উন্নত জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না এবং তারা বস্তি এলাকায় মানবেতর জীবনযাপন করে। বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য হ্রাসে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, খাদ্য সহায়তা, বিনামূল্যে শিক্ষা, কর্মসংস্থান প্রকল্প ইত্যাদি কর্মসূচি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তবে এগুলো মূলত স্বল্পমেয়াদি সমাধান। টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রয়োজন।
প্রথমত, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষা এবং শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বাবলম্বী করতে পারে। দ্বিতীয়ত, কৃষি খাতকে আধুনিকীকরণ করতে হবে এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হলে কৃষি খাতকে টেকসই করতে হবে।
শিক্ষার প্রসার দারিদ্র্য নিরসনের অন্যতম কার্যকর উপায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে, বিশেষ করে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দরিদ্র নারীদের জন্য কর্মসংস্থান ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
একইসঙ্গে, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন করতে হবে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজে চিকিৎসা সেবা পায় এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আয়ের বৈষম্য। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও তা সবার মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবও দারিদ্র্য নিরসনের পথে বড় বাধা। তবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের সম্ভাবনা অনেক।
দেশের অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, রপ্তানি খাত শক্তিশালী হচ্ছে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নও দৃশ্যমান। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। গ্রামীণ উন্নয়ন ও ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও এখনও দেশের উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের শিকার। শুধুমাত্র সাময়িক সহায়তা নয়, দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আয় বৈষম্য কমাতে হবে, যাতে উন্নয়নের সুফল সমাজের সব স্তরে পৌঁছায়। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই দীর্ঘদিনের।
গত কয়েক দশকে দেশ অনেক অগ্রগতি করেছে, তবে সামনে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সমন্বয়। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সমন্বিত ও কার্যকর নীতি গ্রহণ করাই হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।