পিএইচডিধারী এমপিও শিক্ষকরাও বৈষম্যের শিকার!
ড. মোজাফফর হোসেন
প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়েছে প্রায় ৭৫ বছর আগে। এরও আগে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের জন্য শিক্ষানীতি প্রবর্তন করেছিল। ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের Educational Despatch নীতিতে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক প্রদেশে শিক্ষা পরিচালনার জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্ট সৃষ্টি করা হবে। এর ফলে ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বে (মুম্বাই) ও মাদ্রাজে (চেন্নাই) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং Grants in-Aid প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাবটি পরে সরকারের শিক্ষানীতি হিসাবে কাজ করে। এসব শিক্ষা প্রস্তাবের কোনোটিতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে কোনো সুপারিশ লক্ষ করা যায়নি। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অবহেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে যুগের পর যুগ।
শিক্ষায় ব্রিটিশদের শৈথিল্য লক্ষ করে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চেতনা সংগঠিত হতে থাকে। এ সময় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম সংস্থাগুলো একত্রে ব্রিটিশ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। এর মধ্যে ১৮৯৯ সালে লর্ড কার্জন ভাইসরয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাতীয়তাবাদী জনগণের চাপে তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুটিকয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন, যেগুলো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের আদর্শ হিসাবে কাজ করবে বলে মনে করা হয়েছিল এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল। এ ধারাটিই বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে এখনো বলবৎ থাকতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ সরকারি শিক্ষা বিভাগ দ্বারা বেসরকারি শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ১৮৩৫ সালে ‘Mecaulays Minute’ প্রস্তাবে বলা হয়, সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার কোনো দায়দায়িত্ব গ্রহণ না করে সবিশেষ উচ্চশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করবে, যার প্রভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্বংক্রিয়ভাবে সচল থাকবে। এ ধারাটিই এখনো চলছে।
গত ফ্যাসিস্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রীরা বলতেন-পাকিস্তানি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের কাজ চলছে। কিন্তু তারা ঔপনিবেশিক শিক্ষার ধারা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইত না। দুঃখের বিষয়, ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারা এখনো যে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ঘাড়ে চেপে বসে আছে, সে কথা শিক্ষামন্ত্রীরা ইচ্ছা করে ভুলে বসে ছিলেন।
বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টার অবগতির জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে, রাষ্ট্রপতির আদেশে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির গেজেট প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। শিক্ষা উপদেষ্টা যদি এই গেজেটটির দিকে নজর দিতেন, তাহলে পিএইচডি অর্জনকারী এমপিও শিক্ষকরাও আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন না। অথচ এই বৈষম্যের ব্যাপারটি এমন যে, তা ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির কদর্য্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
১৪ অক্টোবর ২০২১ তারিখে প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে একটি আদেশ (গেজেট) হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ধারা ১৫-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার.../২০১৫ দ্বারা জারিকৃত চাকরি আদেশ সংশোধন করেছে। সংশোধনে বলা হয়েছে, (২ক) (ক) উপ-অনুচ্ছেদ (২)-এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পিএইচডি ডিগ্রিসহ প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত অথবা চাকরিরত থাকাকালীন পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী শিক্ষা বিভাগীয় কোনো কর্মচারী (শিক্ষক) যে পদে কর্মরত থাকিবেন, উক্ত পদের জন্য নির্ধারিত ও আহরিত বেতন গ্রেড অনুযায়ী তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ৩ (তিন)টি অগ্রিম বেতনবৃদ্ধির সুবিধাপ্রাপ্য হইবেন। এই আদেশের বলে সরকারি কলেজে কর্মরত পিএইচডি অর্জনকারী শিক্ষকরা আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনটি অগ্রিম বেতন বৃদ্ধির সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে আসছে। অথচ এমপিওভুক্ত পিএইচডি অর্জনকারী শিক্ষকদের এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ইতঃপূর্বে এমপিও কলেজের পিএইচডি অর্জনকারী শিক্ষকরা পিএসসির মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করে উচ্চপদে সরকারি কলেজে যোগ দিতে পারতেন। এই সুযোগটি সৃষ্টি করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সে কারণে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং শিক্ষা ক্যাডারের কতিপয় হীনমন্য আমলার যোগসাজশে সেই সুযোগটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং প্রশাসনের আমলারা পর্যন্ত আর্থিক সুবিধা, পদোন্নতি পেলেও এমপিও শিক্ষকরা বঞ্চিত রয়েছেন যুগ যুগ ধরে। কী অপরাধ তাদের? কেন তাদের অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রিকে অসম্মান করা হচ্ছে? একটি গবেষণা সম্পন্ন করতে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়, সেই পরিশ্রমের কি কোনোই মূল্য নেই?
কেন এই বিমাতাসুলভ আচরণ? কার পরামর্শে এমপিও শিক্ষকদের ঠকানো হচ্ছে? এসব খুঁজে বের করার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টার মনোযোগ প্রত্যাশা করছেন এমপিও শিক্ষকরা। প্রধান উপদেষ্টাসহ ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের সরকার গবেষণার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। কিন্তু গবেষকদের এভাবে বিভাজন করে যে অসম্মান-অপদস্থ করা হচ্ছে, তা কি শিক্ষা উপদেষ্টা জানেন? তাকে জানানোর কি কেউ নেই? গবেষণার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশে যে গেজেট হয়েছে, তাতে পিএইচডি অর্জনকারী শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে পিএইচডি অর্জনকারী এমপিও শিক্ষকরা গুরুত্ব হারাবেন, এতে কি রাষ্ট্রপতির সম্মতি রয়েছে? নাকি রাষ্ট্রপতির অগোচরে এমপিও শিক্ষকদের ঠকানো হচ্ছে?
আমার বিশ্বাস, প্রধান উপদেষ্টা জানতে পারলে তিনি পিএইচডির মর্যাদা সমানভাবেই বিবেচনা করবেন। বৈষম্যের এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাভবনের আগের পরিচালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপিওভুক্ত পিএইচডি শিক্ষকদের ব্যাপারে গেজেটে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই বিধায় তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ২০১৫ সালের বেতন স্কেলের সংশোধিত গেজেটেও তো এ কথা লেখা নেই যে, এমপিও শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইনক্রিমেন্ট দেওয়া যাবে না। তাহলে কেন? এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আপনারা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন।
বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় আমলার অনিচ্ছার কারণে এমপিও শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ সব বৈষম্য নিরসনের উদ্দেশ্যেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানও সেই লক্ষ্যেই সংঘটিত হয়েছে। আশা করা যায়, এ বৈষম্যেরও নিরসন হবে দ্রুতই।
ড. মোজাফফর হোসেন : প্রাবন্ধিক