এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি
গাজী মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কেউ যদি বৈঠা হাতে নৌকা বেয়ে থাকেন তিনি জানবেন, নিস্তরঙ্গ নদীর কিনার থেকে ছেড়ে এসে তীব্র স্রোতের মধ্যে পড়লে নৌকা ঘুরে যেতে চায়। দক্ষ মাঝি তখন বৈঠা, স্রোত আর নৌকাকে সমন্বয় করে গতিপথ সোজা রাখতে ঘনঘন একবার ডানে আরেকবার বামে বৈঠা চালান। জুলাই-আগস্টের টালমাটাল সময়ের পরবর্তী সময়টি হচ্ছে সেই নদী। বর্তমান সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস হচ্ছেন এ নৌকার চালক। নিঃসন্দেহে তিনি একজন দক্ষ মাঝি। বিশ্বব্যাপী তার আকাশচুম্বী সুনাম থাকায় তাকে বলা যেতে পারে ছোট নৌকার বড় মাঝি। সাম্পান আর সমুদ্র দেখে দেখে তিনি অভ্যস্ত। তিনি কি সাম্পানকে সঠিক লক্ষ্যের তীরে পৌঁছাতে পারবেন? সাম্পানে করে খোলভর্তি নানা সওদা আসবে কি? তাতে থাকবে কি সোনালি, রুপালি মাছ? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে জনগণকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে-নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ‘এই ডুবেছে’, ‘ডুবল বুঝি’ বলে আওয়াজ তোলা লোক জড়ো হয়েছে অনেক। তারা আগের জনবিরোধী সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের চোখে বর্তমান সরকারের জন্য বিপদের আগাম আশঙ্কা মেলে ধরার অপচেষ্টা দৃশ্যমান। তবু আগের জনবিরোধী সরকারের সমর্থকদের নিরাশ হতে হবে; কারণ, অভিজ্ঞ মাঝি ঠিকই যাত্রী হিসাবে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে যাবেন সঠিক গন্তব্যে। এর কোনো বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের বুকে গৌরবের সঙ্গে টিকে থাকতে হবে। টিকে থাকতে হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বহির্বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নেতার দরকার; এ বিষয়টি সমালোচকরা বুঝতে চাইছেন না। বড় বড় দেশের নেতারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের শুভাকাঙ্ক্ষী। বিশ্বের তাবত এ রিসোর্সফুল ফ্যান ক্লাবের গুণী-জ্ঞানী শুভানুধ্যায়ীদের শুভদৃষ্টি থাকলে অশুভ শক্তি টিকতে পারবে না। ঠিক সময়ে সূর্য পূর্বাকাশে উঁকি দেবেই। সেই শুভ সময়ের প্রতীক্ষায় আছে দেশবাসী। একটা একটা ফাড়া কেটে যাচ্ছে, তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছি। আমরা লক্ষ্য করছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মনোবল বেড়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের বাজারে আগের তুলনায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে একটি-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে এবং পাসপোর্ট-ভিসাবিষয়ক জটিলতা কেটে যাচ্ছে। আগের সুবিধাভোগীদের নানা অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত এসব টিকবে না। জনগণ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। ফাঁকিজুকির উন্নয়ন দিয়ে এখন হাততালি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আগামীতে যে সরকারই আসুক না কেন শাসন করার নামে অনৈতিক সুবিধা নিতে, তাদের জন্য সময় হবে কঠিন থেকে কঠিনতর।
রিজার্ভ যদি তিন হাজার মার্কিন ডলারের কাছে নেওয়া যায়, তাহলে আমদানি খাতে সাহসী ভূমিকা নিতে পারবে সরকার এবং আর্থিক সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে খুশি রাখার বাড়তি প্রকল্প এবং হাততালি পাওয়ার জন্য স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ টাইপের প্রকল্পগুলো কাটছাঁট করা গেলে, প্রকল্পে নিয়মনীতি ফিরে আসবে এবং ঋণের ওপর চাপ কমবে। সরকারি-বেসরকারি সেবা এবং উৎপাদন কাজ যাতে হীন রাজনৈতিক মানসিকতার কারণে থমকে না যায়, তার পরিবেশ নিশ্চিত করা-এসব দিকেও সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সুবিশাল ব্যক্তিত্ব ব্যবহার করে যদি রেমিট্যান্স খাতে আরও গতি সঞ্চার করতে পারেন, সেইসঙ্গে রপ্তানি আয় বাড়াতে নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করতে পারেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেন, তাহলে পরে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, সেই সরকার একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারবে। এভাবেই আগের জনবিরোধী সরকারের সমর্থকদের নিরাশ করে বর্তমান সরকার এগিয়ে যাবে, এটাই আমার ধারণা।
নদীতে নৌকা ছাড়ার প্রথম ক্ষণের উপমা দিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম। প্রথম প্রথম সব কাজই কঠিন থাকে। একবার সে কঠিন সময় উতরানো গেলে সুদিন ফিরে আসে। সুদিনে স্তাবকদের অভাব হয় না, এটা আমরা জানি। কিন্তু শুরুর সময় কিছু মানুষ ঘাপটি মেরে থাকে, তারা অপেক্ষা করে এবং বুঝতে চায়- সাম্পান ডুববে, না ভেসে থাকবে। আমার ধারণা, অল্প দিনের মধ্যেই এ সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার ভিত্তি আরও দৃঢ় হবে। তখন দোদুল্যমান মানসিকতার এসব লোকেরাই আসবে প্রশংসার ডালি নিয়ে। ওদের স্তুতিবাক্য ক্ষতি ছাড়া কারও উপকার করেছে, এমন নজির নেই। টালমাটাল সময়ে যারা পাশে আছে, তারাই আসল বন্ধু এবং নির্ভরযোগ্য কর্মী, দেশের বিবেকবান মানুষ। তাদের মধ্যে ফাটল না ধরলে এ সরকারকে তারা সমর্থন দেবেন এ কারণে যে, এ সরকারের প্রধান এমন এক ব্যক্তি, যিনি আমাদের নতুন করে আত্মমর্যাদার বিষয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
গাজী মিজানুর রহমান : সাবেক যুগ্ম সচিব ও প্রবন্ধকার