শেখ হাসিনা
হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম চলাকালে রোজ আমাদেরকে শুনতে হতো পুলিশ ও অন্যান্য সরকারি চাকুরেদের রাজনৈতিক ও দলীয় ভাষণ। তাদের বেয়াদবি ও ঔদ্ধত্য ছিল লাগামছাড়া। 'পুলিশিরাষ্ট্র' এই তত্ত্বকথাটা আমরা তার আগে শুধু কেতাবে পড়তাম। হাসিনার আমলে হাতেকলমে তার বাস্তব প্রয়োগ আমরা দেখেছি।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোনো ফারাক হাসিনা রাখেন নি। বরং সরকারের মধ্যে তিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। তাই যখন তার শাসন-কর্তৃত্ব ছাত্রজনতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লো তখন দেখা গেলো তার আর কোনো দল নাই। হাসিনার পতন ও পালানোর পরেও প্রমাণ হয়েছে, আওয়ামী লীগ নামের দলটি পুরোই অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। এখনো যারা হাসিনার রাজনৈতিক পুনরুত্থানের আশা নিয়ে নানা ভাবে সক্রিয়তা দেখাতে সচেষ্ট তারা মূলতঃ হাসিনা-রেজিমের অবৈধ সুবিধাভোগী মাত্র। এরা জানে, হাসিনাকে ফেরানো না গেলে তাদের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
এই যে সত্তর বছরের পুরানো একটি দল, যারা টানা প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে বলে প্রচারিত হতো, সে দলটি ক্ষমতাচ্যুতির সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেলো। সে দলকে 'বটগাছ' কিংবা 'ফিনিক্স পাখি' বলে যতই তেল মাখানো হোক না কেন, সাবেকি আওয়ামী লীগের জেগে ওঠার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবে তারা অস্ত্র, অর্থশক্তিতে বলীয়ান এবং সীমান্তের বাইরের মদতে কিছু সহিংসতা ও নাশকতা চালিয়ে যেতে পারবে।
পুনর্জন্ম নিতে হলে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে পুরো খোলনলচে বদল করে আসতে হবে। অথচ অনুশোচনাহীন হাসিনা-দোসরদের মধ্যে তেমন কোনো আলামত এখন পর্যন্ত নজরে আসছে না। কাজেই আ.লীগকে ফের আশু দণ্ডায়মান করার বাসনাকে আপাততঃ হিমাগারেই রাখতে হবে।
পতিত আ.লীগ ও হাসিনাকে আগের আদলেই ফিরে তাদের 'হারানো স্বর্গ' পুনরাধিকার করতে হলে চারটি পথ আছে। এগুলো হচ্ছে- এক. যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো ভারতের সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশ দখল করে নিয়ে হাসিনাকে ফের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। দুই. ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের মতো গণবিপ্লব ঘটিয়ে যদি আ.লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে। তিন. যদি সশস্ত্রবাহিনী ক্যু করে হাসিনাকে এনে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। এবং চার. যদি নির্বাচনে দেশবাসীর রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারে।
এই যে চারটি পথ তার প্রতিটিই রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে অসম্ভবের বাধার দেয়াল। অতএব, এসব পথে ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন আ.লীগের জন্য অলীক হয়েই থাকবে। বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে হলে আওয়ামী লীগকে প্রথমেই অতীতের দুঃশাসন ও সকল অপকাণ্ডের জন্য অনুতাপ, পরিতাপ ও অনুশোচনা করতে হবে। দেশবাসীর কাছে দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। হাসিনাসহ যারা হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও দুর্নীতি করেছে, তাদেরকে ত্যাজ্য করতে হবে। তাদের কোনো অন্যায়-অপরাধের দায় নেওয়া যাবে না এবং অপরাধীদের বিচার ও সাজা চাইতে হবে। ভিনদেশের আনুগত্য ও ফ্যাসিবাদকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক ও দেশভিত্তিক রাজনীতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সর্বস্তরে অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে দলকে পুনর্গঠিত করতে হবে। এভাবে জনগণের দরবারে গেলে সময়ের পরিক্রমায় একসময় হয়তো আ.লীগ ফের গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। এরজন্য দরকার ধৈর্য্য ও সংযম। অস্থির হয়ে উঠলে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কাই বেশি থাকবে।
হাসিনা তার প্রায় ষোলো বছরব্যাপী দীর্ঘ শাসনে যা-কিছু করেছেন তার পরিণামে ক্ষমতা হারাবার সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশে ঠাঁই লাভের জন্য এক চিলতে জমিনও খুঁজে পাননি। ভরসা করা ও আস্থা রাখার মতন এই দেশে একজন মানুষও আর অবশিষ্ট ছিলনা তার জন্য। তাকে যেতে হলো ভারতে পালিয়ে। ইন্ডিয়ার বাইরে আর এমন একটি মিত্রদেশরও সন্ধান হাসিনা পেলেন না, যে দেশটি তাকে দিতে পারে আশ্রয়। সবাই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দূর দূর করে প্রত্যাখ্যান করেছে তার সকাতর আবেদন। এমন ব্যর্থতা, এমন গর্দিস ও জিল্লতির জিন্দেগি জগতে বিরল। অবশেষে ইন্ডিয়ার ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিতে হয়েছে তাকে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাহারা হাসিনা প্রমাণ করলেন বাংলাদেশ নয়, ইন্ডিয়ার প্রতিই তার প্রকৃত আনুগত্য।
বাংলাদেশের ইতিহাসের হাসিনা অধ্যায়ের বিয়োগান্তক পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। এ অধ্যায়ের আর 'রিওপেন'-এর কোনো অবকাশ নেই। এখন শুরু হবে তার কৃতকর্মের বিচার ও শাস্তির পালা। সে বিচার তার উপস্থিতিতে নাকি অনুপস্থিতিতে সম্পন্ন হবে তা' নির্ধারণ করবে পরবর্তী আরো কিছু ঘটনাবলী। নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার নির্মোহভাবে ন্যায্যতার সঙ্গে হাসিনা ও তার অপকর্মের দোসরদের সে বিচার সমাধা করতে পারবে বলেই মনে হয়।
এই বিচার ও সংস্কারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের অধ্যায় ও তার পুনরুত্থানের আশঙ্কা মুছে দেওয়ার পাশাপাশি এই সরকারের বড় দায়িত্ব হচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ও গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের উপযোগী একটি নির্ভরযোগ্য ও স্থায়ী নির্বাচনি পদ্ধতির প্রবর্তন করা। সেই সঙ্গে অতি দ্রুততায় সরকারকে আরো চারটি লক্ষ্য যে-কোনো মূল্যে অর্জন করতেই হবে। না-হলে জনগণের উৎসাহব্যঞ্জক সমর্থনের অভাবে অন্য পদক্ষেপগুলো 'সকলি গরল ভেল' হয়ে দাঁড়াবে। এক. বন্যা ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি সত্বেও নিত্যপণ্যে দাম নিম্নআয়ের মানুষের নাগালে ফিরিয়ে আনা। দুই. বিদ্যুৎ সংকটকে দুঃসহ হয়ে উঠতে না দেয়া। তিন. বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রশমনের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা যদ্দুর সম্ভব স্বাভাবিক রাখা। চার. যানজটকে অসহনীয় পর্যায়ে যেতে না দেওয়া।
এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে প্রয়োজন, যত জলদি সম্ভব 'টিম ইউনূস'কে পুনর্বিন্যস্ত করা। আধা অবসরপ্রাপ্ত এবং অনেকটা রুটিন দায়িত্ব পালন করতে আসা সদস্যদের আধিক্যের কারণে এ টিমের দুর্বলতা ও গতিহীনতা ইতোমধ্যেই প্রকটভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। দরকার হলে মাথাপিছু কাজের ভার কমাতে এই টিমকে আরেকটু বড়ও করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে সরকারের চারপাশে দৃশ্যমানভাবে জনসমর্থনের বলয় সৃষ্টি করতে হবে।
গুজব ও অপপ্রচারকে সম্বল করে পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ইতোমধ্যে ইতি-উতি মাথা তোলার অপপ্রয়াস শুরু করেছে। এই অপচেষ্টাকে দমিয়ে দিতে সরকারের প্রচার ফ্রন্টকে এক্ষুনি দেশে-বিদেশে, মূলধারার ও সোশ্যাল মিডিয়ায়, অনলাইন ও অফলাইনে সবক্ষেত্রে জোরদার ও সক্রিয় করতে হবে।
লেখক পরিচিতি
মারুফ কামাল খান: লেখক-সাংবাদিক, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেসসচিব।