![স্পেশাল প্রসিকিউশন ও মনিটরিং ছাড়া হবে না](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/09/07/image-848065-1725707922.jpg)
বিগত দিনগুলোতে সবচেয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের বিচারের নামে অতীতের মতো তথাকথিত প্রহসনমূলক মামলা দিয়ে বিচারকার্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। প্রথমে কতিপয় ব্যক্তি মিডিয়ায় আসার প্রতিযোগিতায় মামলা দেওয়া শুরু করেন, মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই। কিছুদিন পর যখন পুলিশ তার কর্মস্থলে যোগ দেয়, তারা হাস্যকরভাবে স্টেরিওটাইপ বয়ান দিয়ে মামলা রুজু করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে এবং করে চলছে।
প্রতিটি মামলায় শেখ হাসিনা, তার কতিপয় চিহ্নিত মন্ত্রীদের বারংবার এবং এর সঙ্গে আওয়ামী ঘরনার সুবিধাভোগী নানা ধারার ব্যক্তিদের ঢালাওভাবে বিভিন্ন জেলায় প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রধান আসামি করা হচ্ছে। এতে করে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত মূল আসামিদের ভূমিকা গুরুত্বহীনভাবে উপস্থাপিত করে মামলা দুর্বলভাবে সাজাচ্ছে পুলিশ। প্রতিটি মামলার বয়ান মূলত একই রকম এবং প্রকৃত ঘটনা পরিক্রমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। একইসঙ্গে পুলিশ এবং বিগত সরকারদলীয় গুণ্ডাদের দ্বারা সংঘটিত অনেক হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য অপরাধে ৫ আগস্টের আগেই ছাত্র-জনতা, স্থানীয় অনেক ব্যক্তির নামে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে একই ঘটনায় পরস্পর বিপরীত একাধিক মামলার অবতারণা হয়েছে। পুলিশের এ অপতৎপরতা অনেকটাই স্বভাবগত, যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে বানানো গল্প দিয়ে মানুষকে হয়রানি করা পুলিশের স্বাভাবিক কাজে পরিণত হয়েছিল।
আশঙ্কা হচ্ছে, বর্তমানে যেনতেনভাবে এসব মামলার বিচার করা হবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের জনপ্রিয় দাবির কাছে অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয়তো নিম্ন আদালতে সাজাও হয়ে যাবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, অনেক মামলা তদন্তে কিংবা মামলা পরিচালনায় সাক্ষ্য-প্রমাণ দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয় অথবা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় আপিলে উচ্চতর আদালত ওইসব ইচ্ছাকৃত বা উদাসীনতাজনিত দুর্বলতার কারণে আসামিদের বেনিফিট অব ডাউট দিতে বাধ্য হন এবং এতে আসল ক্রিমিনালও খালাস পেয়ে যায়। তাই পরিতাপের বিষয় হবে, সঠিক তদারকির অভাবে মামলার বর্ণনা, তদন্ত, সাক্ষ্য এবং এর পরিচালনায় চতুরতা বা শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন করে নিম্ন আদালতে আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করার পরও যদি এসব ভয়ংকর খুনি ভবিষ্যতে আইনি মারপ্যাঁচে উচ্চ আদালত থেকে পার পেয়ে যায় এবং বিজয়ী বেশে শকুনের হাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে।
সব হত্যাকাণ্ড হাজারও ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নির্বিকার ও নির্লজ্জভাবে সংঘটিত হয়েছে। পুলিশ ও হেলমেট বাহিনী প্রকাশ্যে জনতার ওপর পাখির মতো গুলি করে নারকীয় হত্যালীলায় মেতে উঠেছিল। গুলি করে আবার উল্লাসে আপ্লুত হয়ে পৈশাচিক ধ্বনি দিয়েছে-‘একটা মরছে’! পরোয়া করেনি তাদের এ নারকীয়তা হাজারও ক্যামেরাবন্দি হওয়াকেও। যেখানে প্রায় সব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ টিভি চ্যানেল, ইউটিউব কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কালপ্রিটরা নাম-ঠিকানাসহ চিহ্নিত হয়েছে, সেখানে অধিকাংশ মামলায় যে পুলিশ ও হেলমেট বাহিনী সরাসরি গুলি করেছে এবং যে অফিসার, ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় প্রশাসন বা দলীয় নেতা গুলি করতে হুকুম দিয়েছেন, তাদের নাম ও সংশ্লিষ্টতা সুস্পষ্টভাবে মামলায় উল্লেখ করার সুযোগ রয়েছে। শুধু আইওয়াশ হিসাবে হাসিনা এবং তার চিহ্নিত মন্ত্রীদের নাম প্রথমে রেখে মামলা রুজু করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।
ভুলে গেলে চলবে না, সরকার পতনের মূল স্লোগান ছিল-‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। সারা দেশে বিশাল ছাত্র-জনতা নির্বিচারে খুনের বিচারের দাবিতেই প্রথম কোটা আন্দোলন ছেড়ে গণজাগরণের সূচনা করে। তাই প্রহসনের বিচার হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। জাতি কোনো দিন ক্ষমা করবেন না এ তামাশা। তাই সঠিক তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অচিরেই উদ্যোগ নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি :
১. ঘটনাগুলোর ব্যাপকতা এবং এর পরিধি পুরো দেশব্যাপী হওয়ার কারণে পুলিশকে দিয়েই প্রচলিত আইনে তদন্ত করতে হবে। তবে যেহেতু পুলিশের তদন্ত নিরপেক্ষ ও যথাযথ হওয়ার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, তাই চব্বিশের গণআন্দোলনে নিহত ও আহত হওয়ার প্রতিটি ঘটনার সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিটি মামলার তদন্ত ও পরিচালনায় শক্ত হাতে তদারকি করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক। ২. অনতিবিলম্বে একজন অভিজ্ঞ ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীর নেতৃত্বে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, ফৌজদারি আইনজীবী, ফৌজদারি আইনের শিক্ষক, আইনের ছাত্র, তদন্তে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, আইটি বিশেষজ্ঞ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সেন্ট্রাল স্পেশাল প্রসিকিউশন অ্যান্ড মনিটরিং সেল বা কমিশন গঠন করা। ৩. যেসব জেলায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে একটি জেলা প্রসিকিউশন অ্যান্ড মনিটরিং টিম গঠন করা, যার সদস্য হিসাবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, স্থানীয় ফৌজদারি আইনজীবী, শহিদ পরিবারের মধ্য থেকে এক বা একাধিক প্রতিনিধি, জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা থাকবে। মামলার আধিক্য ভেদে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা। স্থানীয়ভাবে নির্দিষ্ট মামলায় নিযুক্ত তদন্ত কর্মকর্তা (‘আইও’) সংশ্লিষ্ট জেলা মনিটরিং টিমের আওতায় থাকবে। মনিটরিং টিম প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত, সাক্ষী সংগ্রহ এবং আইও কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। সব সংগৃহীত তথ্য সেন্ট্রাল মনিটরিং টিমকে পাঠাবে এবং উভয় মনিটরিং টিম ওই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আইওকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে এবং মামলায় নিযুক্ত আইনজীবীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ করবে। ৪. প্রতিটি টিমের সঙ্গে একদল আগ্রহী ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে রিসার্চ এবং তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। ভিডিও ফুটেজগুলো সেন্ট্রাল কমিশনের একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করা যেতে পারে, তাতে পুরো প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হবে। তবে প্রতিটি ভিডিও আইটি বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষিত হতে হবে। ৫. যেসব আইনজীবী এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকবেন, তারা নিজেরা মামলা পরিচালনা করবেন অথবা নিযুক্ত আইনজীবীদের সার্বক্ষণিক সহায়তা দেবেন। ৬. প্রতিটি মামলার বিচারকার্য দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল বা ন্যূনপক্ষে অতিরিক্ত জেলা জজের একটি ডেডিকেটেড আদালতের মাধ্যমে সম্পাদন করা। ৭. সেন্ট্রাল কমিশন ও জেলা মনিটরিং টিমের সদস্য হিসেবে সৎ, যোগ্য ও সাহসী ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। উভয় টিমকে প্রয়োজনীয় অর্থ ও লজিস্টিক সাহায্য দেওয়া। কমিশনের ও জেলা টিমের কার্যকালের সময়সীমা নির্ধারিত থাকবে। ৮. পুরো প্রক্রিয়াটি প্রয়োজনে একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইনি কাঠামোতে নিয়ে আসা জরুরি, যাতে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ ও পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস, কমিশন বা জেলা টিমকে সার্বিক সহযোগিতা করতে আইনগতভাবে বাধ্য হয় এবং ভবিষ্যতে তাদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। ৯. আইন, স্বরাষ্ট্র ও ছাত্র সমন্বয়কদের প্রতিনিধি উপদেষ্টারা এ সেন্ট্রাল কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা এবং প্রত্যক্ষভাবে তদারকি করবেন।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন শহিদের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার এবং জনতার প্রাণের দাবি, তেমনি পতিত স্বৈরাচারের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন, তা সারা বিশ্ব সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে। আমরা যেনতেনভাবে শাস্তি চাই না, চাই ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রতিটি অপরাধের সঠিক বিচার। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সত্যিকারের অপরাধীর শাস্তি হতে বাধ্য। মুগ্ধ, আবু সায়ীদ, রামপুরার ৬০ বছরের মায়া ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের ৬ বছরের রিয়া গোপসহ সহস্রাধিক শহিদের আত্মা অঝোরে কাঁদবে, যদি আমাদের উদাসীনতায় একটি নারকীয় পশুও আইনের হাত দিয়ে পুনর্বাসিত হয়ে সমাজে ফিরে আসে।
ব্যারিস্টার মঈন ফিরোজী : আইনজীবী, আপিল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট