আজকের নার্সিসিজমের যুগে আমরা যখন নিজে দেখার চেয়ে অন্যকে দেখাতে বেশি পছন্দ করি,তখন পহেলা বৈশাখ পালনের চেতনা ক্রমশ মূলধারা থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় অত্যন্ত অপ্রকৃষ্ট রূপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যে সাংস্কৃতিক ধারাটি স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন বয়ে নিয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে ত্বরান্বিত করার প্রত্যয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তা আজ ধর্ম-বর্ণ-গোত্রকেই শুধু আলাদা অবস্থানে দাঁড় করাচ্ছে না বরং একটির বিরুদ্ধে অপরটিকে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে নিয়ে গেছে।
বাঙালির ‘নওরোজ’ বলে বর্ণিত পহেলা বৈশাখ মূলত কৃষিজীবী মানুষের দেনা পাওনা চুকিয়ে নতুন বছর শুরু করার ঘটনা থেকে শুরু হয়েছিল। রাজপরিবারে এই বিষয়টিকে ‘পূন্যাহ্’ আর ব্যবসায়ী মহলে বিষয়টিকে বলা হয় ‘হালখাতা’। কৃষক পরিবারে মাঙ্গলিক এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘আমানিও’।
আজকের নগরবাসীর জন্য এটি পান্তা-ইলিশ, লাল-সাদা, আর মঙ্গল শোভাযাত্রা তথা বর্ষবরণ। কিন্তু মূলত যে মঙ্গলকে সামনে রেখে এটি পালনের কথা বলা হয় তা ব্যক্তির মনে কতখানি শোভনযাত্রা সৃষ্টি করে তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। যেহেতু মঙ্গলের বিপরীতে অবস্থিত অমঙ্গল মনুষ্য সৃষ্ট একটি প্রত্যয়, সেহেতু মঙ্গলের জন্য মানুষের মনেই আগে আন্দোলন সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন, কেননা বিধাতা অমঙ্গলের জন্য দায়ী নয়,এর জন্য দায়ী মানুষের মনের প্রবৃত্তি।
সমাজের প্রতিটি মানুষে- মানুষে আজ যে বৈষম্য তা পহেলা বৈশাখ কমানোর প্রত্যয় নিয়ে এসে অলক্ষ্যে বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিম্নবর্গ উপর তলার মানুষের লাল-সাদা পোশাক দেখে আরও নিচে নেমে যাচ্ছে, নিম্নমধ্যবিত্ত পান্তা-ইলিশের যোগান দিতে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছে, মধ্যবিত্তের বৈশাখী ভাতা কম পড়ে যাচ্ছে।
ঈদকে কেন্দ্র করে যেমন সবাই নতুন পোশাক পরে তেমন বৈশাখকে কেন্দ্র করেও নতুন পোশাক অনেকের জন্য বাধ্যতামূলক। অথচ এই মানুষগুলো জানেই না যে বৈশাখে লাল সাদা কেন পরা হয়। হালখাতা'র সঙ্গে এর কোনো সংযোগ আছে কি না।
ব্যবসায়ীরা এদিনে তাদের ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে পাওনা আদায় করেন, কিন্তু গরিবদের সমাজে অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে একই উচ্চমূল্যে দ্রব্যসামগ্রী যে কিনতে হয় তা নিয়ে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালনের উদ্যোগ এই দিনে নিতে খুব দেখা যায়না কোনো ব্যবসায়ীকে। শ্রেণি বৈষম্য কমিয়ে এই দিনটাকে কেন্দ্র করে কেউ সমতা সৃষ্টির সংকল্প করে না। যে কৃষক পরিবারের ফসলকে কেন্দ্র করে এই ব্যবধান দূর করার উৎসব তাদের কাছে প্রাপ্য পারিশ্রমিক পৌঁছে দেওয়ার যাত্রা দেখা যায় না এইদিনে।
একদিকে শিল্প-সংস্কৃতির মানুষ গাইছে ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’ আবার অপরদিকে পহেলা বৈশাখের ভিড়ে প্রজন্ম লাঞ্ছিত হচ্ছে প্রজন্মের হাতে। শোভাযাত্রার ভিড়ে কে কাকে কীভাবে অপমান করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালি ঐতিহ্যকে পুনরায় সামনে নিয়ে হাঁটা মানুষগুলো পান্তাকে এই একদিনের ঐতিহ্য বানিয়ে অন্যকে দেখায়, কিন্তু নিজে দেখে না যে সে কয়দিন পান্না খেয়ে দিন আরম্ভ করে। আর রইল হরেক রকম বাহারি ভর্তা।
গরিব মানুষের নিত্যসঙ্গী যে ভর্তা-পান্তা তাকে একদিনের মূল্যায়ন করে শ্রেণিবৈষম্য আমরা বরং বাড়াচ্ছি। কমাচ্ছি না। অনেকে আবার সদ্য বাঙালিত্ব প্রাপ্ত হয়ে নিউ ইয়ারের নিজস্ব ভার্সন প্রতিষ্ঠা করেন পহেলা বৈশাখে, কিন্তু সঠিকভাবে সালটার হিসেবও রাখেন না। বাংলা মাস ও ঋতুর নাম মনে না রাখা একটা হাসির কাণ্ড। যারা পারে না তারাও হাসে, যারা সে হাসি দ্যাখে তারাও হাসে যদিও সে নিজেও জানে না৷ আর জানলেও বানান করতে পারে না।
তাই যদি হয় তবে অগ্নিস্নানে ধরা শুচি হয়েও লাভ কী, আমরাই যদি পরিশুদ্ধ না হতে পারি? ফলাফল হয়ত এই যে, বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা ভিড়ের মধ্যে আমাদের ভারে ঘামে যখন তখন বিরক্ত হই এই ভেবে যে,কাজ না করতে পারলে বাইরে বেরুনো কেন। আত্মা পবিত্র করা প্রয়োজন।
সারা দেশে শহরে শহরে রাস্তাগুলো আলপনায় রাঙিয়ে আমরা কেউ কেউ প্রতিযোগিতা করি কোনটা দীর্ঘতম আলপনা, অথচ সবাই মিলে সড়ক আইন মানার সংকল্প করি না। রাস্তায় যার যত বড় ও দামি গাড়ি বিবাদে তার চোখটাও ততো দাপটে রাঙা আর অন্যকে নিচুস্তর মনে করিয়ে দেওয়ার প্রবণতায় ছোট। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার মঙ্গলোৎসব হিসেবে শোভাযাত্রা বের করে যেখানে চারুকলা বিভাগের প্রদর্শনী এবং কিছুটা আত্মপ্রচার থাকে। আবার মুখে বলি মুছে যাক গ্লানি,মুছে যাক জরা। জরা যদি নিজের মনেই থাকে তবে শুধরাতে চাই কার মনকে?
এইতো গেল এক বিভেদের কথা, এবার আসি অন্য বিভেদ প্রসঙ্গে। ‘বৈশাবী’ নিয়ে প্রস্তুতি চলে পহেলা বৈশাখের বহু আগে থেকে। একটা ছোট্ট বাংলাদেশ আমাদের, এখানে বিবিধ জাতির বড় বড় বিবিধ অনুষ্ঠান। কারো ‘বৈসু’, কারো ‘সাংগ্রাই’, আবার কারো ‘বিজু’। কথা হচ্ছে একত্রীকরণই যদিই নববর্ষের প্রার্থনা হয় তবে কেন এত পৃথক আচার-অনুষ্ঠান। জাতি হিসেবে উপজাতিরা ভিন্ন কিন্তু দেশীয় পরিচয়ে একটি দেশ একত্রে যদি একটি জায়গায় এক হতে না পারে তবে অতৃপ্তি তো থেকেই যায়।
এতদ্বিবিষয়ক চিন্তনে ধর্মের বিষয়টি আপেক্ষিক, কেননা আমরা এখনো অপ্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রেও নিজেদের মুসলমান কিংবা হিন্দু বলে পৃথক থাকি পৃথক হই। কেউ কেউ আবার পহেলা বৈশাখ পালনকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ মনে করেন মনে মনে, যদিও বাংলা বছরের প্রবর্তকই একজন বিখ্যাত মুসলমান শাসক। তবে তা হয়ত পহেলা বৈশাখ পালনের বর্ধিত কিছু আচার-অনুষ্ঠানের কারণে ভাবা হয়, কারণ মোঘল সম্রাট আকবর যখন বাংলা সন চালু করেন তখন তা পালনের পরিধি মঙ্গল শোভাযাত্রা, কিংবা পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ব্যাপ্তিতে বিস্তৃত ছিল না।
কিন্তু জাতীয় একটি অনুষ্ঠানকে যদি কেউ হিন্দুদের সম্পত্তি বলে ঘোষণাই করেন তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের আপত্তি করার তো কিছু থাকেই না। বোধ করি তারা বিষয়টিকে উপভোগই করে। মাঝখান থেকে যা হয় তা হলো মানুষে-মানুষের মিলনের বিপরীতে বিচ্ছেদ হয়। তাই জাতীয় কল্যাণ আর ঐতিহ্যই যদি ব্রত হয় এবং নতুন সূচনা আর জীর্ণতাটাকে ভোলাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে একদিনের বাঙালি সেজে বিভেদ সৃষ্টি না করে করে অন্তরে আলো জ্বালিয়ে সম্মান করতে হবে সকল ধর্মকে, বর্ণকে, গোত্রকে; পৃথক না হয়ে এক হতে হবে মনুষ্যত্বে, কেননা এতেই মঙ্গল, বাহ্য অনুষ্ঠানে নয়।
লেখক: শিক্ষক, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি