রাজপথে আন্দোলনে ঢুকে পড়ছে শাহবাগীরা, দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৭:২১ এএম

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। যাওয়া আগে তিনি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের দায় মাথায় নিয়ে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন। তার সহযোগীরা কিছুদিন চুপ থাকলেও নানা কৌশলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অনুচররা রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার যে পরিকল্পনা করছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের চক্রান্তকারী ও আওয়ামী সুবিধাভোগী কিছু বামপন্থি গোষ্ঠী।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় তাদের অপতৎপরতা দৃশ্যমান হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। একটি ঘটনায় বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থী ও গণমানুষের কিছু ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে আওয়ামী দুর্বৃত্ত চক্রটি নামে-বেনামে ঢুকে পড়ছে মূল স্রোতের সঙ্গে।
এ নিয়ে রাষ্ট্রকে কঠোর হতে জোর তাগিদ দিয়েছেন ফ্যাসিস্টবিরোধী জোটের রাজনৈতিক নেতা ও দেশের ছাত্রসমাজ। তারা বলেছেন, এ বাংলায় ফ্যাসিস্টদের আর ঠাঁই হবে না। তারা পোশাক বা রং বদলে জনস্রোতের সঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করলেও তা প্রতিহত করা হবে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের ওপর হামলায় ইন্ধনদাতাসহ নেপথ্য দুর্বৃত্তদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় এরই মধ্যে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। হামলার নেপথ্যে ইন্ধনদাতা হিসাবে শাহবাগের কেউ হোক বা অন্য কেউ জড়িত থাকুক, তদন্ত করে বের করা হবে। যারাই অস্থিতিশীলতার চেষ্টা করবে তাদের প্রতিহত করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহবাগের এসব চক্রান্তকারীদের ইন্ধনে হাসিনা সরকার যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অনেক রাজনীতিবিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। বিচারের নামে সেই প্রহসনের ঘটনার স্কাইপি কেলেঙ্কারি ফাঁস হলেও নিবৃত্ত হননি হাসিনার পদলেহনকারী বিচারকরা।
এই শাহবাগী গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদের চক্রান্ত ও চাপের কারণেই মতিঝিলে শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামাদের নির্বিচারে হত্যা করে আওয়ামী সরকার। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা ও ইমরান এইচ সরকারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে বুধবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের সেই শাহবাগী দোসর লাকী আক্তার হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন। বিষয়টি মঙ্গলবার সবার নজরে আসে। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে স্লোগান ও বক্তব্য দিতে দেখতে পেয়ে তাকে গ্রেফতারের জোর দাবি জানিয়েছেন ছাত্র সমাজ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রেফতারের দাবিতে বুধবার শাহবাগে অবস্থান নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। লাকীর তৎপরতা ও তার পেছনে কারা ইন্ধন দিচ্ছে তা চিহ্নিত করতে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থা।
গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে জানান, আন্দোলনের নামে পুলিশের ওপর হামলা ও মারধরের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আন্দোলনের পেছন থেকে কারা কলকাঠি নাড়ছে, কারা মাঠে বাস্তবায়নে ছিল-সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সেটি খোঁজা হচ্ছে।
মঙ্গলবার ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী প্রতিবাদকারী কিছু তরুণ-তরুণী বিক্ষোভ করে শাহবাগের সমাবেশ থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে যান। উদ্দেশ্য ছিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণসহ ৯ দফা দাবিসংবলিত স্মারকলিপি দেবে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায়। আন্দোলনকারীদের একাংশ ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগোতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়।
এ সময় তারা পুলিশের ওপর হামলা শুরু করে। পুলিশ সদর দপ্তর এক বিবৃতিতে সেদিনের প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে। যাতে বলা হয়, ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের ৬০-৭০ জনের একটি দল পুলিশকে আক্রমণ করে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রটি জানায়, প্রকাশ্যে ধূমপান করার ইস্যুতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে কুশপুত্তলিকা দাহ করার পেছনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উসকে দেওয়ার পেছনে কাজ করে শাহবাগী একটি গোষ্ঠী। এসব আন্দোলনের নেপথ্যে এক তরুণীর নাম উঠে আসে। মঙ্গলবার লাকী আক্তারের অংশগ্রহণের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভকে পুঁজি করে শাহবাগী চক্রটি নানা চক্রান্তের বিষ ছড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম বলেছেন, ‘বাংলাদেশপন্থি ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে তৈরি হওয়া বিভাজনের সুযোগ নিচ্ছে দেশবিরোধী শক্তি। তারাই শাহবাগের বিচারহীনতা ও ফ্যাসিবাদের আইকন লাকী আক্তারকে পুনর্বাসন করছে। শাহবাগের মাধ্যমেই হাসিনার ফ্যাসিজমের উত্থান এবং পূর্ণতা। লাকীরা ছিল আওয়ামী লীগের চেতনা ব্যবসার ইনভেস্টমেন্ট ও রক্ষাকবচ। গায়ে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে আর শাহবাগ হতে দেব না, ইনশাআল্লাহ।
জান দেব, জুলাই দেব না! বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বুধবার যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের ওপর এ ধরনের হামলার ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। ফ্যাসিবাদের পতনের পর যেখানে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ভেঙে পড়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ কখনো কাম্য ও সমর্থনযোগ্য নয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে লিখেছেন, শাহবাগ একদিনে গড়ে ওঠেনি। এককভাবে কেউ শাহবাগ গড়ে তোলেনি। শাহবাগ কায়েম করতে সমর্থন দিয়েছিল তথাকথিত সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, আমলা, সাংস্কৃতিক কর্মী, বিদেশি এজেন্ট, রাজনীতিবিদ এবং ক্রীড়াবিদরাও।
শাহবাগ কেড়ে নিয়েছিল এ দেশের মানুষের বাক-স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সব ধরনের মৌলিক মানবাধিকার। কেড়ে নিয়েছিল স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে গুম, খুন, আয়নাঘর, বিচারিক হত্যাকাণ্ডসহ যাবতীয় অপকর্মের বৈধতা দিয়েছিল শাহবাগ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান রেজাউল করিম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে ডিবি। নেপথ্যে লাকী আক্তার বা অন্য যেই থাকুক, শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বানে শাহবাগে জমায়েত শুরু হয়। পরে তা গণজাগরণ মঞ্চ হিসাবে পরিচিতি পায়। এর মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব পান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী চিকিৎসক ইমরান এইচ সরকার। তাদের ইন্ধন দেয় কিছু সুশীল ও তৎকালীন সরকার।
সূত্রমতে, সে সময় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্তরা হলেন-নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এসএম শুভ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান তারেক, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর রুসমত, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) সভাপতি হোসাইন আহমেদ তফছির ও সাধারণ সম্পাদক সামছুল ইসলাম সুমন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি প্রবীর সাহা ও সাধারণ সম্পাদক সৈকত মল্লিক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তমাল।