গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব
বিইআরসির শুনানিতে হট্টগোল, বিক্ষোভ

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৪০ এএম

শিল্পখাতে গ্যাসের দাম ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ দশমিক ৭২ টাকা করার শুনানিতে ব্যাপক হট্টগোল হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, নানা ধরনের স্লোগান দেন। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ অংশগ্রহণকারীদের অনেকে শুনানি থেকে ওয়াকআউট করেন। প্রতিবাদকারীরা বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে হুমকির মুখে পড়বে বিনিয়োগ-ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাত। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাহত হবে দেশের অর্থনীতি। দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাব রোববারের মধ্যে খারিজ করার দাবি জানান। দাবি না মানলে এ আবেদন আন্দোলনে রূপ নিতে পারে বলে তারা জানান। তারা বলেছেন, সরকারের এই প্রস্তাব ভয়ঙ্কর গণবিরোধী।
হট্টগোলের মুখে পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্ধারিত সময়ের আগেই মধ্যাহ্ন বিরতির ঘোষণা দেন বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আমলে নিয়ে বুধবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে শুনানির ডাক দেয় বিইআরসি। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ দশমিক ৭২ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাব শুনানির প্রথম পর্বেই তুমুল বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এর বিরোধিতা করে অংশগ্রহণকারীদের একটি দল শুনানি অবিলম্বে বাতিলের দাবি তোলে। একটি অংশ ওয়াকআউট করে রাজপথে মানববন্ধন করে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শুনানিতে ক্যাব, বিকেএমইএ, বিসিআইসহ বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের গ্যাসের মূল্য নির্ধারিত হবে আমদানি করা এলএনজির প্রকৃত ব্যয়ের ভিত্তিতে। অনুমোদিত লোডের বেশি ব্যবহারকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। শুনানি শুরু হলে প্রথমে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে তাদের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এরপর বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির পক্ষে তাদের উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর দুপুর ২টায় পুনরায় শুনানি শুরু হয়। এ সময় জানানো হয়, শিল্পকারখানার বয়লার ও শিল্পকারখানার জেনারেটরে (ক্যাপটিভ) সরবরাহ করা গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তার ওপর শুনানি গ্রহণ করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলেছে, প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫.৭০ টাকা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৫.৭২ টাকা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের প্রাইস গ্যাপ কমাতে হবে।
শুনানিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের বক্তব্যের পরপরই প্রতিবাদকারীরা স্লোগান দেন। একই সঙ্গে তারা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধিরা শুনানি থেকে ওয়াকআউট (ত্যাগ) করেন। ক্যাব নেতারা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে প্রহসন, বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক বলে আখ্যা দেন। এটা শিল্প ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র ও অশনি সংকেত।
এ সময় ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বিইআরসি আসলে সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়ন করছে। কমিশনের উচিত স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সরকারের চাপে নতি স্বীকার না করা। সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা যদি এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন এবং এর কারণ অনুধাবন করতে না পারেন, তবে আমাদের শিল্প খাত বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাবে।
জেরা পর্বের প্রথমেই জেরা করতে আসেন ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম। তিনি প্রায় ৫০ মিনিট কথা বলেন। তিনি এই প্রস্তাবকে গণবিরোধী বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই অযৌক্তিক প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া উচিত হয়নি। শিক্ষার্থীরা শুনানি বন্ধের দাবি জানিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। বিইআরসি চেয়ারম্যান বারবার তাদের থামানোর চেষ্টা করলেও হট্টগোল চলতে থাকে।
ক্যাব সদস্যরা ওয়াকআউট করে বিয়াম ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করে মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন, এক লাফে তিনগুণ দাম বৃদ্ধি হলে নতুন কোনো শিল্প হবে না।
সরকারকে প্রয়োজনে এখন ভর্তুকি দিতে হবে, দাম বাড়ানো যাবে না। মানববন্ধনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, বিইআরসির কাজ হওয়ার কথা গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমানো। কিন্তু তারা দাম বৃদ্ধি নিয়ে শুনানি করছে।
শুনানি শেষে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, যারা বক্তব্য দিয়েছেন এবং যারা দেননি এমনকি কোম্পানির পক্ষ থেকেও শুনানি পরবর্তী লিখিত মতামত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারও কোনো মতামত থাকলে আগামী ৭ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে জমা দেওয়া যাবে। আমরা সব পক্ষের মতামত শুনলাম, সবকিছু বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, হ্যাঁ এ কথা সঠিক শিল্পে দুই ধরনের দর বৈষম্য তৈরি হতে পারে। অনেকেই শুনানি বন্ধের দাবি করেছিলেন, আমাদের বক্তব্য হচ্ছে আজকে সব পক্ষের কথা শুনতে পারলাম। সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
শুনানিতে বিকেএমইএ সভাপতি হাতেম আলী বলেন, অবান্তর অযৌক্তিক প্রস্তাবের শুনানি বন্ধ করার বিনীত অনুরোধ করছি। ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা হলে নতুন শিল্প আসবে না, শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আশা করি শিল্প খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করবেন না।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেছেন, আমার মনে হয় না পেশাদার কোনো লোক এই প্রস্তাব দিতে পারে। পেছনে কোনো অপেশাদার লোক এবং স্বার্থান্বেষী গ্রুপ কাজ করছে দেশের শিল্প বন্ধ করার জন্য। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির উদ্দিন বলেন, এভাবে ৩০ টাকার গ্যাসের দাম ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়ে আমরা কি মেসেজ দিচ্ছি দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। আপনারা কি বলতে চাচ্ছেন স্টপ শিল্পায়ন, নতুন শিল্পের দরকার নেই। দয়া করে গ্যাসের দাম বাড়াবেন না। এটার মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
ব্যারিস্টার তামিম হোসেন বলেন, শিল্পে দুই ধরনের গ্যাসের দাম করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিইআরসি আইন অনুযায়ী দুই ধরনের ট্যারিফ নির্ধারণের সুযোগ নেই। এই প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য এবং বেআইনি। সংবিধানে সবার অধিকার সমান করা হয়েছে। সে হিসাবে সংবিধান পরিপন্থি এই প্রস্তাব।
বিটিএমইএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, আমরা বিনিয়োগ করে ফেঁসে গেছি। ব্যবসা বন্ধ করতে পারছি না, ব্যাংক ঋণ রয়েছে বলে। না হলে অনেক আগেই বন্ধ করে দিতাম। এখন যে ৩০ টাকা দিচ্ছি সেটাই অনেক বেশি। আমরা গ্যাস পাচ্ছি না, আর আপনারা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। আপনারা ব্যবসাটা কি ভারতের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন! দয়া করে শিল্পকে ভারতের হাতে তুলে দেবেন না।
বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বলেন, দফায় দফায় গ্যাসের দাম বেড়েছে কিন্তু আমাদের কমিশন বাড়েনি। এতে করে আমাদের ব্যবসা চালিয়ে নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলাম, তারা ২০১৭ সালে বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু বিইআরসির পক্ষ থেকে এতদিনেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সদস্যদের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে আমরা রমজান মাস বলে সময় দিচ্ছি। কিন্তু ঈদের পরে ধর্মঘটে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি তার মূল্যায়ন রিপোর্টে বলেছে, এলএনজি আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ আবার ভোক্তা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মুসক রয়েছে। দুইবার মুসকের বিষয়টি সমাধান করা গেলে এলএনজি আমদানি পর্যায়ে ঘনমিটার প্রতি ৭.৩৪ টাকা কমে আসে। এতে করে ঘাটতি কমে আসবে।
নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ হলে ওই দুই শ্রেণির ভোক্তারা নতুন সংযোগ গ্রহণে যদি আগ্রহী না হয়, অথবা প্রতিশ্রুত গ্রাহক অনুমোদিত লোডের অর্ধেকের বেশি ব্যবহার না করে, বিদ্যমান গ্রাহকরা যদি অনুমোদিত লোডের বেশি ব্যবহার না করে তাহলে পেট্রোবাংলার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব অর্জিত হবে না বলে মন্তব্য করেছে টেকনিক্যাল কমিটি।
গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা ও সংগঠনগুলো সবাই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। তারা অবিলম্বে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। ওই প্রস্তাব অনুমোদন হলে শিল্পায়ন বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা আদালতে মামলা ঠুকে দেওয়ারও হুমকি দেন। শুনানিতে উপস্থিতি ছিলেন, বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ, সদস্য মিজানুর রহমান, ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, মো. আব্দুর রাজ্জাক ও শাহীদ সারোয়ার।