ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি বঞ্চিতদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করা হবে
বঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ, যাবেন উচ্চ আদালতে

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫১ পিএম

ফাইল ছবি
বিগত আওয়ামী স্বৈরাচার সরকারের শাসনামলে বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ পাননি, তাদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করবে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পুনর্বিবেচনার আবেদন নেবে। মন্ত্রণালয়টির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, মূল্যায়ন কমিটি সবার আবেদনই বিবেচনা করবে-এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না। ভুল হতে পারে এবং রিভিউর জন্য যে কেউ আবেদন করতে পারেন। আবার কেউ চাইলে উচ্চ আদালতেও যেতে পারেন।
এদিকে মূল্যায়ন কমিটি যাদের আবেদন বিবেচনায় নেয়নি, তারা যুগান্তরের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত যারা নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে অবসরে গেছেন, তাদের বঞ্চিত দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। সবাই সচিব হবেন-এমন কোনো বিধান বা সুযোগও নেই। অথচ অতিরিক্ত সচিব হয়ে নিয়মিত অবসরে গেছেন-এমন ৫১ জনকে সচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান, যিনি ২০০১ সালে উপসচিব, ২০০৪ সালে যুগ্মসচিব এবং ২০০৬ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি কী কারণে বঞ্চিত, এর ব্যাখ্যা থাকা দরকার। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ১৯৮২ ব্যাচের (রেগুলার ও বিশেষ) ৫০ জনকে সচিব করা হয়েছে। একটি ব্যাচ থেকে এতজনকে কীভাবে সচিব করা হলো, এরও ব্যাখ্যা থাকা দরকার ছিল।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা আরও বলছেন, সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) ছাড়া কাউকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিধান নেই। জাকির আহমেদ খানের কমিটিকে কি এসএসবির সভা করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে? মন্ত্রিপরিষদ সচিব হচ্ছেন এসএসবির সভাপতি, তার অনুপস্থিতিতে কীভাবে সভা হলো? তারা বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ারও ঘোষণা দেন। বঞ্চিতরা আরও বলেন, সরকারের উচিত স্বচ্ছতার স্বার্থে মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশ করা। সরকার যেমন প্রকাশ করেছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন।
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত নানাভাবে হয়রানি ও পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অবসরে গেছেন-এমন কর্মকর্তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষতি পুষিয়ে দিয়ে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে কমিটির সভাপতি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে সদস্যসচিব করা হয়। বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবেদনের জন্য এক মাস সময় দেওয়া হয়। কমিটিকে ৯০ দিন সময় দিয়ে একসঙ্গে অথবা কেস টু কেস আবেদনগুলো পর্যালোচনা করতে বলা হয়। কমিটির বিবেচনার জন্য ১ হাজার ৫৪০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ৭৬৪ জনকে রোববার পাঁচ স্তরে অর্থাৎ সচিব, গ্রেড-১, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বাদ পড়েন ৭৭৬ জন কর্মকর্তা।
বঞ্চিত কর্মকর্তা বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচের (বিশেষ) মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আবেদন করেছিলাম। এখন বুঝলাম নিরপেক্ষরা সব সরকারের আমলেই বঞ্চিত হয়। সে কারণে এ বিষয়ে আমার কোনো অনুভূতি নেই। বিসিএস ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক অতিরিক্ত সচিব আবুয়াল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পাঁচবার বঞ্চিত হয়ে যুগ্মসচিব এবং চারবার বঞ্চিত হয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছি। বারবার বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি জ্যেষ্ঠতা। জুনিয়র ব্যাচের সচিবের অধীনে চাকরি করেছি। মূল্যায়নের জন্য আবেদন করেছিলাম। রোববার ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির আদেশ দেখে খুবই হতাশ হয়েছি। তিনি আরও বলেন, ১৯৮৪ ব্যাচের এমন কর্মকর্তাও আছেন যিনি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন, তিনি চাকরিজীবনে মাত্র একবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। পক্ষান্তরে আমি মোট ৯ বার বঞ্চিত হয়েছি।
বিসিএস দশম ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবির মিলন যুগান্তরকে বলেন, একজন কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে অবসরে গেলে তাকে কেন সচিব করা হলো না, সে বিষয়ে তিনি সরকারকে প্রশ্ন করতে পারবেন না। জনপ্রশাসনে এটি একটি সাধারণ নিয়ম। কারণ, সবাইকে সচিব করতে হবেÑএরকম বিধান বা সুযোগ কোনোটাই নেই। প্রশ্ন করতে পারবেন তারা, যারা বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন বা ওএসডি ছিলেন। মাহবুব কবিরের প্রশ্ন-ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির মাধ্যমে সচিব হওয়া ১১৯ জনের মধ্যে ৫১ জন অফিসার অতিরিক্ত সচিব পদে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে অবসরে গেছেন, তারা কী করে সচিব হলেন? তিনি আরও বলেন, বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচ (রেগুলার ও বিশেষ) থেকে ৫০ জনকে ভূতাপেক্ষভাবে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানও রয়েছেন। মাহবুব কবির আরও বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তো কখনো পদোন্নতিবঞ্চিত হননি। তাহলে তিনি কী করে সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন।
মাহবুব কবির আরও বলেন, জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে কি এসএসবির সভা করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে? এসএসবির সভাপতি ও অন্য সদস্যদের অংশগ্রহণ ছাড়া কীভাবে সভা হলো এবং পদোন্নতির সুপারিশ করা হলো। এভাবে যদি প্রশাসনের সুনাম ও ঐতিহ্য নষ্ট করা হয়, তাহলে গণমানুষের কাছে প্রশাসন সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে প্রতিকারের জন্য আমরা কয়েকজন কর্মকর্তা শিগ্গিরই উচ্চ আদালতে যাব। জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির দেওয়া পদোন্নতি চ্যালেঞ্জ করব। তিনি মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশ করার দাবি জানান।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান কোনো মন্তব্য করেননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ওবায়দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ফারদার রিভিউর জন্য আবেদন নেওয়া হবে। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বঞ্চিতরা আবার আবেদন করতে পারেন। এছাড়া তারা চাইলে প্রতিকারের জন্য উচ্চ আদালতে মামলায় যেতে পারেন। সব দরজাই খোলা আছে। এক প্রশ্নের জবাবে এপিডি বলেন, জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত সব কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে বাধ্য না। কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।