সক্রিয় করতে প্রধান উপদেষ্টার তিন নির্দেশ
বেজা’র আইনে চলবে কোরিয়ান ইপিজেড
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:০২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
জটিলতায় আটকে থাকা দেশের একমাত্র বেসরকারি ইপিজেড (কোরিয়ান-ইপিজেড) প্রকল্প সক্রিয় করতে তিন নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্য দিয়ে দেশের একমাত্র বেসরকারি এই ইপিজেডে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোরিয়ান কর্তৃপক্ষ ও বিনিয়োগকারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
কারণ, কোরিয়ান ইপিজেড পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ সেল ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হাতে। সেই সেল থেকে সরকারি সহায়তার অভাবে ইয়াংওয়ান করপোরেশন কোরিয়ান ইপিজেড ঠিকভাবে পরিচালনা ও বিনিয়োগ আনতে পারছিল না। এতে দেশ বঞ্চিত হয়েছে বড় ধরনের বিনিয়োগ থেকে। সেই জায়গায় এখন নতুন করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের কাজ আরও সুদৃঢ় হচ্ছে। কোরিয়ান ইপিজেড সক্রিয় করতে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া নির্দেশনায় রয়েছে জমির নামজারি সম্পাদন ও মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা।
এছাড়া পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে কোরিয়ান ইপিজেডকে সমন্বয় করা। অর্থাৎ বেজার প্রশাসনিক কার্যক্রমের যে বিধিবিধান আছে, তা দিয়ে কোরিয়ান ইপিজেড আগামী দিনে পরিচালিত হবে। যদিও বর্তমানে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেসরকারি ইপিজেড পরিচালিত হচ্ছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের গভর্নর বোর্ড’ বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই বৈঠকে নামজারির জটিলতার সমাধান ও মামলা নিষ্পত্তির জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া কোরিয়ান ইপিজেডের আইন বাতিল করে বেজার সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেজাকে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার পর ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং একটি বৈঠক করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কোরিয়ান ইপিজেডের জমি সমস্যার সমাধান করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই কোরিয়ান ইপিজেড বাংলাদেশের জন্য একটি মডেল হিসাবে দাঁড়াক। এটি বড় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে এবং বহু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।’
এর আগে বৈঠকে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে কিছু সমস্যা দ্রুত সমাধানের অনুরোধ জানান কিহাক সাং। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের মধ্যে কেইপিজেড স্থাপনের চুক্তি হয়। ওই চুক্তির আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান এই ইপিজেড স্থাপনের অনুমোদন পায়। ১৯৯৯ সালের ১০ অক্টোবর রাঙ্গুনিয়া ইপিজেডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কেইপিজেডের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়। তবে জমি নিবন্ধন ও নামজারি না হওয়ায় অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এখানে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। ইয়াংওয়ান করপোরেশন পরিচালিত কেইপিজেডে বর্তমানে ৪৮টি শিল্পে ৩৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
জানা যায়, চিটাগং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইয়ুম চৌধুরী পৈতৃক সম্পত্তিতে এই ইপিজেড তৈরির উদ্যোগ নেন। স্থানীয় কয়েকজনও তাদের জমি ইপিজেডের জন্য তাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরী সমন্বয় না করায় এবং আশপাশের বাকি জমিগুলো অধিগ্রহণ করা সম্ভব না হওয়ায় প্রকল্পটি থমকে যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে প্রকল্প থমকে যাওয়ায় ৯ বছর ধরে বাংলাদেশ বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের গভর্নর বোর্ড বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২ ডিসেম্বর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘদিন এ বৈঠক না হওয়ায় এটাই দৃষ্টান্ত-প্রকল্পটির (কোরিয়ান ইপিজেড) প্রতি তৎকালীন সরকারের উদাসীনতার প্রমাণ। তিনি কোরিয়ান ইপিজেডে জমির নামজারিসহ অন্যান্য মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির আশ্বাস দেন।
কোরিয়ান ইপিজেড পরিচালনা কীভাবে হচ্ছে, তাও বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি ইপিজেডবিষয়ক বোর্ড অব গভর্নরস অধীন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একটি নির্বাহী সেল আগে থেকেই রয়েছে। সেখান থেকে বেসরকারি ইপিজেড ও এর প্রশাসন ব্যবস্থাপনা এবং কার্যক্রম নিমন্ত্রণ করা হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ইয়াংওয়ান করপোরেশনের জমিসহ অন্যান্য সমস্যা দ্রুত সময়ে সমাধান করা উচিত। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড নিয়ে কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বাণিজ্যসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন, জমির নামজারিসহ সমস্যাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে কোরিয়ান ইপিজেডের। পাশাপাশি কোরিয়ান বিনিয়োগসহ বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কোরিয়ান ইপিজেডের জমির প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করা দরকার। আমরা বিনিয়োগ সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে চাই। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করা উচিত বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে বেসরকারি ইপিজেড বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বৈঠকে বলা হয়, বেসরকারি এই ইপিজেডের (কোরিয়ান) কার্যক্রম বেজার কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাজের প্রকৃতি ও বিনিয়োগ সেবা প্রদানের ধরন প্রায় একইরকম। এ অবস্থায় একটিমাত্র বেসরকারি ইপিজেড পৃথকভাবে পরিচালনা না করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে পরিচালনা করা যুক্তিযুক্ত বলে প্রতীয়মান হয়। এতে এর কার্যক্রম সহজ ও ত্বরান্বিত হবে, কাজের গতিও বাড়বে।
এ প্রস্তাবে সমর্থন দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল আইন, ১৯৯৬ বাতিল এবং বেজার আইনে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে ওই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী ইয়াংওয়ান করপোরেশনের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের তাগিদ দেন।
বেজা সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া ইপিজেডে ইনফরমেশন টেকনোলজি ভ্যালি (আইটি ভ্যালি) এবং অ্যাগ্রিকালচার ভ্যালি (অ্যাগ্রো ভ্যালি) গড়ে তোলার প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে ২০০০ সালেই সাবমেরিন কেবল সিস্টেমের শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ব্যাকটেলের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা হয়। ব্যাকটেল এ ইপিজেডে প্রাথমিক পর্যায়ে ৭০০ কোটি টাকা এবং পরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছিল। পাহাড় আর সমতলের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এই ইপিজেডে হেলিপ্যাড, কন্ট্রোল টাওয়ার ও সীমানাপ্রাচীরসহ কিছু স্থাপনাও গড়ে তোলা হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন কোরিয়ান কর্তৃপক্ষকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত ভালো। এতে বিনিয়োগ বাড়বে, অপরদিকে দেশে বেসরকারি এই ইপিজেডে বিনিয়োগের কালো মেঘ কেটে যাবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান।