Logo
Logo
×

জাতীয়

নদী বাঁচাতে প্রয়োজনে দু-চারটে শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেবো: পরিবেশ উপদেষ্টা

Icon

গাজীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৫ পিএম

নদী বাঁচাতে প্রয়োজনে দু-চারটে শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেবো: পরিবেশ উপদেষ্টা

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, অনেক কিছুর বিকল্প তৈরি করা যায়, তবে নদীর বিকল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। প্রকৃতির সঙ্গে কখনো লড়াই করতে নেই, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে জিততে পেরেছে- এ রকম কোনো ইতিহাস নেই। নদী বাঁচাতে প্রয়োজনে আমরা দু-চারটে শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেবো।

তিনি বলেন, অবৈধ দখলদাররা যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বনভূমি ও পরিবেশ সুরক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বৃক্ষনিধন ও শিল্প-কারখানার দূষণ বন্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শনিবার সকালে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। 

পরে দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর পিটিআই অডিটোরিয়ামে তরুণদের নদী ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নিয়ে সচেতন করা এবং তাদের সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ‘নদী রক্ষায় যুব সম্মেলন’ শীর্ষক এক সম্মেলনে তিনি প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দেন।

গত ৫ আগস্টের পরে গাজীপুরে অবৈধভাবে দখল হওয়া ৯০ একর বনভূমির মধ্যে ১৬ একর উদ্ধার করা হয়েছে উল্লেখ করেন উপদেষ্টা। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের বনের সীমানা নির্ধারণের কাজ দ্রুত শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, বন দখলকারীদের প্রতিরোধ করতে কীভাবে কাজ করতে হয় তা আমরা জানি। আগামী তিন মাসের মধ্যে দখল হওয়া জমি উদ্ধারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে সব দিক পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নবায়নের সময় জনগণের মতামত নিতে হবে।

মতবিনিময় সভায় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা নদীকে অনেকগুলো কারণে দূষণ করি। তারমধ্য তিনটি বড় কারণে বেশি দূষণ হয়। একটি হচ্ছে- শিল্প দূষণ, সিটি করপোরেশন-পৌরসভার বর্জ্য ও কারখানার পয়োবর্জ্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্লাস্টিক দূষণ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ অর্ধেকের বেশি নদীপথে যাতায়াত করে। এখনো মরে যাওয়া, দখল হওয়া নদীগুলো আমাদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের কারণে জলবায়ুর মতো ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে তরুণ প্রজন্ম। আগামী প্রজন্ম, যাদের জন্য আমরা গাড়ি-বাড়ি করি, টাকা জমাই, সেই আগামী প্রজন্মই ভয়ংকর সমস্যার সম্মুখীন। তারা পরিবেশের যে বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়বে। 

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, আগামী প্রজন্মকে যদি একটি দূষণমুক্ত নদী না দিতে পারি, তাহলে ওরা পানি পাবে কোথায়, মাছ পাবে কোথায়? মাছই যদি না পায়, তাহলে ওরা মাছে ভাতে বাঙালি না হয়ে ফার্মের মুরগি আর ভাতে বাঙালি হবে!

তিনি আরও বলেন, এই প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো নদীতে পড়ে। ফলে কোনো কোনো নদীতে তিন থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত প্লাস্টিকের আস্তর পড়ে যায়। যেগুলো আর পরিস্কার করা সম্ভব হয় না। একটি প্লাস্টিকে যে পরিমাণ কেমিক্যাল দেওয়া হয়, কিন্তু রিসাইকেল করার সময় কেউ চিন্তা করে না যে, এই কেমিক্যালগুলোর কী হবে!এই প্লাস্টিকগুলো নদীতে গিয়ে ভেঙে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। এই মাইক্রো প্লাস্টিকগুলোকে মাছ খায়। পরে এসব আমাদের রক্তে ও মায়ের দুধে মিশে যায়। এগুলোকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

পলিথিন ব্যাগের বিষয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাকে অনেকেই বলে প্লাস্টিকের ব্যাগ তো এখনো বন্ধ হয়নি। আমি বলি, আপনি যখন বাজারে যান দোকানদার যখন আপনাকে পলিথিন ব্যাগ দেয় আপনি ওটা নেন? আপনি ক্রেতা হিসেবে বলেন, এটা নেব না, এটা নিষিদ্ধ ২০২২ সাল থেকে। আপনার বাবা দাদারা চটের ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতেন। আপনি কেন বাসায় থেকে একটি চটের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন না। ক্রেতাদের বলতে হবে, আমরা এটি নেব না। দোকানদার দিতে চাইলেও ক্রেতারা যদি না নেয়, তাহলে অনেকটা রোধ হবে। ক্রেতাদের প্লাস্টিক ব্যবহারের অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনারা দোকানদারদের বলেন, এটা শুধু নিষিদ্ধই না, এটি আমার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সরকার এই পলিথিন সরানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, ক্রেতাদেরকেও সচেতন হতে হবে। তরুণ প্রজন্ম হিসেবে আপনি প্লাস্টিককে বর্জন করুন, এটি ব্যবহার বন্ধ করে দিন, পরিবর্তন চাইলে আগে আমাদের সবাইকে পরিবর্তন হতে হবে।

নদী দখল নিয়ে তিনি বলেন, নদীকে একটি সুন্দর প্রাণ ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে হবে। আমরা কী নদী সৃষ্টি করতে পারি? যদি না পারি, তাহলে কেনো ধ্বংস করি? নদীগুলোকে শিল্প কারখানার ভাগাড়ে পরিণত করার কোনো অধিকার কোনো শিল্প মালিকদের দেওয়া হয়নি। বিশ্বের কোথাও কোনো দেশে কোনো মালিককে এই অধিকার দেওয়া হয়নি। তারা ব্যবসায়িক লাভের জন্য বর্জ নদীতে ফেলার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। অনেক কিছুর বিকল্প তৈরি করা যায়, কিন্তু নদীর বিকল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। প্রকৃতির সঙ্গে কখনো লড়াই করতে নেই, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে জিততে পেরেছে- এ রকম কোনো ইতিহাস নেই। নদী বাঁচাতে প্রয়োজনে আমরা দু-চারটে শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেবো।

নতুন প্রজন্মদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, উন্নয়নটাকে নতুন প্রজন্মকে নতুনভাবে দেখতে হবে। আমাদের বাতাস পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস। আমাদের নদীগুলো দূষণের মধ্যে অন্যতম। যে উন্নয়ন আপনার বাতাসকে দূষিত করে, আপনার নদীকে মেরে ফেলে, যে উন্নয়ন আপনার কৃষি জমি কেড়ে নেয়, আপনার মায়ের দুধের সঙ্গে মাইক্রগ্রাম মিশে যায়। সে উন্নয়ন আসলে উন্নয়ন নয়। 

রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাদের দেশে একটু সময় এসেছে উন্নয়নকে নতুনভাবে দেখার। আমরা বড় বড় শপিংমল ফ্লাইওভারকে উন্নয়ন বলছি। আপনারা তা বলবেন না। আপনাদের উন্নয়নের সংজ্ঞায় দূষণমুক্ত প্রবাহমান নদী থাকবে, আপনাদের উন্নয়নের সংজ্ঞায় বন থাকবে, বন্য প্রাণী থাকবে।

প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবুর সভাপতিত্বে ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেনের সঞ্চালনায় সম্মেলনের শুরুতেই ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট সেন্টার মালেশিয়ার ম্যানেজার ড. কালিদাসান কালিসাম। 

বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন- গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান, গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন, গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিচার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, বাংলাদেশ কাটার সাকশন ড্রেজার ওয়াল্ড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বশির আহমেদ, বাংলাদেশ বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের সভাপতি  রাশেদুল করিম মুন্না, ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা পরিচালক ড. সোহরাব হোসেন প্রমুখ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম