মুজিবনগর সরকারে নিয়োগ পান সেই সাবরেজিস্ট্রার, যুদ্ধের সময় বয়স ছিল ৫
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩১ এএম
দশতলা ভবন নির্মাণসহ ২৪টি ফ্ল্যাট বণ্টনের তথ্য গোপন করে শুধু জমির অংশ রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় কোটি টাকা। ডেভেলপারদের সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া বাড়ি নির্মাণসংক্রান্ত আমমোক্তারনামা দলিল বাতিলের পর একই সময়ে ১২ জন ডেভেলপারের অনুকূলে জমির অংশ সাবকবলা রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়।
অথচ আমমোক্তারনামা দলিলে উল্লেখ করা ভবন নির্মাণের তথ্য, পাওয়ার দাতা ও গ্রহীতাদের মধ্যে ফ্ল্যাট বণ্টনের তথ্য এবং সাইনিং মানি হিসাবে জমির মালিককে ৫৫ লাখ টাকা পরিশোধের বিষয় নিয়ে সাবরেজিস্ট্রার কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়মানুযায়ী ফ্ল্যাট বিক্রি দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা হলে সরকারকে অতিরিক্ত প্রায় কোটি টাকার বিভিন্ন রকম রাজস্ব দিতে হতো। এই অর্থ ফাঁকি দিতে সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রার এবং দুজন দলিল লেখকসহ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের একটি চক্র দাতা-গ্রহীতার সঙ্গে যোগসাজশ করে এভাবে নিয়মবহির্ভূত রেজিস্ট্রি করেছেন।
এখানে দাতার অনুকূলে থাকা অবশিষ্ট ১২টি ফ্ল্যাটও প্রশ্নবিদ্ধ। সহজে অনুমান করা যায়, সম্পন্ন হওয়া সাবকবলা দলিল এসিল্যান্ড অফিসে উপস্থাপন করে নামজারি সম্পন্ন হবে। এরপর আলোচ্য ২৭টি ফ্ল্যাট বণ্টনে নিজেদের মধ্যে শরিকানা চুক্তি করতে ফের আরও একটি দলিল হবে। সেখানে দেখানো হবে জমির মালিক হিসাবে নিজেরা ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছেন। এভাবে সরকারি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিতে কূটকৌশলের রোডম্যাপ সম্পন্ন হবে।
চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে গত ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। ওই সময় গুলশানের সাবরেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলাম অসুস্থতার কারণে ১৭ দিন ছুটিতে থাকায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন উত্তরা সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, এ রকম ঘটনা অহরহ হচ্ছে। মূলত পাওয়ার দলিল বাতিলের পর এ ধরনের দলিল হয়ে থাকে। কিন্তু সাবরেজিস্ট্রারদের পক্ষে এসব বিষয় খতিয়ে দেখা সম্ভব হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একই সময়ে পাওয়ার দলিল বাতিল করে হয়তো ১২টি দলিল রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু পাওয়ার দলিলের বর্ণনা তিনি পড়ে দেখেননি। এটা ঠিক যে, ডেভেলপার নিয়োগসংক্রান্ত এ ধরনের পাওয়ার দলিল বাতিলের পর ফ্ল্যাট উল্লেখ ছাড়া জমির অংশ রেজিস্ট্রি করার সুযোগ নেই। তবে তিনি ঘুস নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
এ সংক্রান্ত দলিলে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্লটে জমির পরিমাণ ০৬.৩৩ শতক ৩.৮৪ কাঠা। মালিক মো. আব্দুল হামিদ। তিনি ২০০১ সালে মালিক হন সাবকবলা দলিলের মাধ্যমে। দলিল নং-৫১৯১. তাং-২৩-০৪-২০০১। দলিলদাতার বর্তমান ঠিকানা ক-৭৫/এ মহাখালী, দক্ষিণপাড়া, বনানী। এছাড়া স্থায়ী ঠিকানা হিসাবে উল্লেখ রয়েছে বাসা নং ৮, ব্লক-বি, নূরের চালা, পশ্চিম সুখাই সরণি, ভাটারা, গুলশান। আলোচ্য জমিটির সিটি জরিপে নামজারি খতিয়ান নম্বর ৫৯৬৫, জোত-২৩/২১, সিটি জরিপে খতিয়ান নম্বর ৫৫৩ এবং সিটি জরিপে দাগ নম্বর-৪৬৮৯।
এই জমিতে যৌথভাবে দশতলা ভবন নির্মাণের জন্য এই মালিকের সঙ্গে ১২ জন ব্যক্তি ডেভেলপার হিসাবে চুক্তি সম্পাদন করে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি। এরপর এই চুক্তি বাস্তবায়নে ভবন নির্মাণের জন্য জমির মালিক একইদিন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল করে দেন। দলিল নং ৪৬। এই পাওয়ার করতে গিয়ে সর্বোচ্চ স্ট্যাম্প ডিউটি এবং সর্বোচ্চ রেজিস্ট্রেশন ফি প্রদান করা হয়। যেখানে ভূমির মূল্য ধরা হয় ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ১২ জন ডেভেলপার সাইনিং মানি হিসাবে জমির মালিক আব্দুল হামিদকে ৫৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে।
পাওয়ার দলিলে ছক করে দেখানো হয় জমির মালিকসহ অন্যরা কে কোন ফ্ল্যাট পাবেন। এখানে মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা ২৭টি। এর মধ্যে ১২টি ফ্ল্যাট পাবে দলিলদাতা এবং অবশিষ্ট ১২টি ফ্ল্যাট পাবে ১২ জন ডেভেলপার। আরও ৩টি ফ্ল্যাট কার মালিকানায় সেটি জানা সম্ভব হয়নি। দলিলে কারপার্কিংও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমমোক্তারনামা দলিলে শুধু রেশিও উল্লেখ থাকার কথা। ফ্ল্যাট বণ্টন করার কোনো নিয়ম নেই। এই পাওয়ার দলিলের মেয়াদ ছিল ৫ বছর।
এদিকে গত ২ সেপ্টেম্বর পাওয়ার দলিলটি বাতিল করা হয়। বাতিল দলিল নং ৬২৫১। এ দলিল বাতিলের সময় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলা হয়, পাওয়ার গ্রহীতারা শর্ত পূরণ করতে না পারায় বাতিল করা হলো। এটিও মিথ্যা। বাস্তবে তারা শর্ত পূরণ করে বাড়ি নির্মাণ সম্পন্ন করেন। আবার একইদিন মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ১২ জনের নামে পৃথক সাবকবলা দলিল রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। গ্রহীতাদের প্রত্যেকের ক্রয়কৃত সম্পত্তির অংশের পরিমাণ উল্লেখ রয়েছে দলিলে সম্পত্তির তফশিলযুক্ত ১১নং কলামে।
এখানে প্রত্যেকের নামে জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ০০২৩.৮২ অযুতাংশ স্থাপনাবিহীন বাড়ি ভূমি। এটিও একটি জালিয়াতি। কারণ যেদিন এ জমি রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে সেদিনও সেখানে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া দশতলা ভবন দণ্ডায়মান। যা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া এর আগে সিটি জরিপের পর্চার ৯নং কলামে জমিতে ৩ তলাবিশিষ্ট বাড়ি থাকার তথ্যও রয়েছে, যা দলিলে গোপন করা হয়েছে।
অথচ জমিতে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া ১০ তলা ভবনে ২৭টি ফ্ল্যাট থাকলেও গোপন করা হয়। এছাড়া পাওয়ার দলিলের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। কিংবা পাওয়ার দলিল করার সময় যে সাইনিং মানি দেওয়া হয় সে বিষয়েও কোনো বক্তব্য নেই। মূলত সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিতে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া ভবনের ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি না করে এভাবে জমির রেশিও ভাগ করে ১২ জনের নামে পৃথকভাবে সাবকবলা দলিল করে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন প্রত্যেকে নামজারি সম্পন্ন করে ফ্ল্যাট বণ্টনের শরিকানা চুক্তির দলিল সম্পন্ন করে নেবে। ফলে সরকারের ৯২ লাখ ৯৭ হাজার টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থাও ইতোমধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করেছে। সংস্থাটির তদন্তে রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
এভাবে কারচুপির আশ্রয় নিয়ে ছয় ধরনের সাড়ে ১৪% রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্ট্যাম্প ডিউটি দেড় শতাংশ, রেজিস্ট্রি ফি ১ শতাংশ, স্থানীয় কর ২ শতাংশ, ভ্যাট ২ শতাংশ, গেইন ট্যাক্স ৮ শতাংশ এবং এআইটি ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০ টাকা। জমির মূল্য ১৫ লাখ ২৬ হাজার এবং ফ্ল্যাটের মূল্য ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ধরে প্রতিটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে ১২ জন ফ্ল্যাট গ্রহীতা প্রত্যেকে ফাঁকি দিয়েছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার ৮০০ টাকা রাজস্ব।
রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সিন্ডিকেটে দুজন দলিল লেখক প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এরা হলেন আক্তারুজ্জামান বুলবুল ও শামীম আহমেদ। যদিও তারা এ সংক্রান্ত দলিলে নিজেদের মুসাফিদাকারক হিসাবে উল্লেখ করেননি।
অ্যাড. কাজী জহিরুল ইসলাম নামে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবীকে দেখানো হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী আইনজীবীর লাইসেন্স নম্বর দলিলে উল্লেখ করার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। এ বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। সূত্র জানায়, এভাবে দলিল করার জন্য গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে দলিল লেখক আক্তারুজ্জামান বুলবুল ও শামীম আহমেদ দলিল উপস্থাপন করেন। কিন্তু এভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে রাজি হননি সাবরেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আক্তারুজ্জামান বুলবুল প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তিনি দলিল উপস্থাপনের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা দলিল নিয়ে গিয়েছিলাম। এটা সত্য। কিন্তু সাবরেজিস্ট্রার রাজি না হওয়ায় চলে আসি। তবে তিনি দাবি করেন, ‘আমরা পাওয়ার দলিলের মুসাফিদাকারক ছিলাম। কিন্তু পাওয়ার বাতিল ও নতুন করে ১২টি দলিল আমরা করিনি।’
সূত্র জানায়, তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সসহ দেশের বিভিন্ন সাবরেজিস্ট্রি অফিসে রাজস্ব ফাঁকি দিতে মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে এ ধরনের দলিল অহরহ হচ্ছে। তবে সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে তিনজন সাবরেজিস্ট্রারকে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে লুৎফর রহমান মোল্লার নামও রয়েছে। যিনি সাতক্ষীরা সদরে কর্মরত থাকাবস্থায় একবার কারাগারে গিয়েছিলেন।
জমি রেজিস্ট্রি করার সময় জালজালিয়াতি ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ায় সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লাসহ জড়িত ৩ জনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী মামলা করেন। দুদক আইনে মামলাটি করা হয়। এ মামলায় তিনি কয়েকদিন কারাগারে ছিলেন। এ তথ্যও গোপন করা হয়। কারাগারে থাকার সময়কে ছুটি হিসাবে দেখানো হয়। ইতোমধ্যে এ মামলার তদন্ত শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। খুলনার বিশেষ জজ আদালতে মামলা নং-১৩/২০১৮।
চার্জশিট পরবর্তী বিচারের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন খুলনার পাবলিক প্রমিকিউটর খন্দকার মুজিবুর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, মামলা যখন ট্রায়ালে যাবে তখন আসামি পক্ষ উচ্চ আদালতে থেকে এটি স্থগিত করার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচার শুরু হলে চার্জশিটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী আসামিদের অবশ্যই শাসিত হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা জেল খাটার কথা অস্বীকার করলেও মামলার কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি প্রতিবেদককে বিভ্রান্ত করতে দাবি করেন, মামলাটি ছিল মিথ্যা। তাই ইতোমধ্যে এ মামলায় তিনি খালাস পেয়ে গেছেন।
এদিকে লুৎফর রহমান মোল্লা ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসাবে সাবরেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী হিসাবে এ সংক্রান্ত মামলায় আদালয়ের রায়ে তিনিসহ ১৮৯ জন সাবরেজিস্ট্রার পদে চাকরিতে প্রবেশ করেন। তবে জন্ম সাল অনুযায়ী যুদ্ধের সময় লুৎফর রহমান মোল্লার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। কারণ তার জন্ম ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি। তাহলে পাঁচ বছরের শিশু কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে কীভাবে সহায়তা করেছেন। এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি রিপোর্ট করার জন্য অনুরোধ জানান।
প্রসঙ্গত, মুজিবনগর কর্মচারী হিসাবে যারা সাবরেজিস্ট্রার হিসাবে চাকরি পেয়েছেন তাদের অনেকে তখন শিশু ছিলেন। এ তালিকার ১৮৯ জনের মধ্যে এখনো ২৬ জন কর্মরত। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসাবে যারা সাবরেজিস্ট্রার হয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বেশি।