Logo
Logo
×

জাতীয়

তিন মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শুল্ক–কর ফাঁকি উদঘাটন

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৪ পিএম

তিন মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শুল্ক–কর ফাঁকি উদঘাটন

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিন মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শুল্ক-কর ফাঁকি উদঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এছাড়া ছোট-বড় সব ধরনের করদাতার কর ফাঁকির তদন্ত কাজও করছে সংস্থাটি। আবার এনবিআরের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্ক বিভাগের সংস্কার প্রক্রিয়াও চলমান আছে।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিজেদের ৯০ দিনের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব খাতে কী ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা–ও জানানো হয়েছে এই প্রতিবেদনে। 

এনবিআরের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগ ২৮৬ কোটি টাকার কর ফাঁকির ঘটনা খুঁজে পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি কর ফাঁকির তথ্য পেয়েছে ভ্যাট বিভাগ। এ খাতে সব মিলিয়ে ১৬৭ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য মিলেছে। এজন্য ১০৩টি ভ্যাট ফাঁকির মামলা হয়েছে। গত তিন মাসে এসব মামলার বিপরীতে ৬৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।

অন্যদিকে শুল্ক বিভাগে ৩৯ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে। ৫৭টি মামলার বিপরীতে সাড়ে ৬ কোটি টাকার মতো আদায় হয়েছেও গত তিন মাসে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) সব মিলিয়ে গত তিন মাসে ৭৪ কোটি টাকা আদায় করেছে। তবে প্রতিবেদনে কার কাছ থেকে কত শুল্ক-কর ফাঁকি পাওয়া গেছে তা উল্লেখ করেনি।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের শীর্ষ ছয় ব্যবসায়ী ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির বিষয়ে তদন্তে নামে এনবিআর। 

ওই ছয় শীর্ষ ব্যবসায়ী হলেন বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম এবং এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম। 

তারা সবাই শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী, আমলাসহ সন্দেহভাজন করদাতাদের কর ফাঁকির তদন্ত করা হচ্ছে।

এছাড়া সৎ করদাতারা যাতে নিরুৎসাহিত না হন সেজন্য কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার দুই মাসের মাথায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই সুবিধা বাতিল করে দেয় এনবিআর। এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেনি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি বর্তমান সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যাতে স্থিতিশীল থাকে সেজন্য চাল, চিনি, পেঁয়াজ, ডিম ও ভোজ্যতেলের আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অগ্রিম আয়কর কমানো হয়েছে।

এনবিআরের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শুল্ক স্টেশনে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার পণ্য পড়ে ছিল। সেগুলোর দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে ১৬০ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় করা হয়েছে। 

এ ছাড়া গত তিন মাসে প্রায় ৩৫ কেজি সোনা আটক করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, মোবাইল ফোন, সিগারেট ও মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৫৩ কোটি টাকার ব্যান্ডরোল ও স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়েছে।

অনলাইন–ব্যবস্থা জোরদার

গত ৯ সেপ্টেম্বর অনলাইনে বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমার ব্যবস্থা চালু করেছে এনবিআর। এ সেবা চালুর পর এ পর্যন্ত দুই লাখ করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টে এনবিআরের প্রায় ৩০ হাজার মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে ডেটাবেজ তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টের ডেটাবেজের সঙ্গে সমন্বয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় আটকে আছে।

অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিলের হার ৮৫ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানায় এনবিআর। আগামী মার্চের মধ্যে শুল্ক বিভাগের ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করার লক্ষ্যও নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি।

এনবিআরের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মাঠপর্যায়ে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি ও বিধিবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে জড়িত করদাতা ও কর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থার ফলে রাজস্ব প্রশাসনে গতি আসতে শুরু করেছে।

তিনি বলেন, পতিত সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এর মধ্যেও জুলাইয়ের নেতিবাচক অবস্থা থেকে অক্টোবর নাগাদ রাজস্ব আদায়ে পৌনে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিপুল রাজস্ব ঘাটতি থেকে যাওয়ায় শুরু থেকেই এবারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ফলে স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী তিন মাসে পৌনে ৯ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির পরও লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৩ শতাংশের বেশি ঘাটতি থেকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথাসম্ভব অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন মেয়াদের সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াকে অটোমেশন করা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) ব্যবহারসহ নানা পদক্ষেপ রয়েছে এই সংস্কার উদ্যোগে। কর্মকর্তারা আশা করছেন অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের অগ্রগতি আসবে।

এনবিআর কর্মকর্তা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টার দিক নির্দেশনা অনুসারে আমরা রাজস্ব আদায়ে গতি আনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। তারা একটি স্বচ্ছ রাজস্ব প্রশাসন তৈরির বিষয়ে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছেন। এই পরামর্শকে সামনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কারের বিভিন্ন মেয়াদে উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ করছে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, পতিত সরকারের শেষ মাস জুলাইয়ে এনবিআরভুক্ত খাতসমূহে রাজস্ব আদায়ে ৭.১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। পরবর্তী আগস্ট মাসের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা গণবিস্ফোরণের মুখে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। নতুন সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। এর ফলে আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪.৩৪ শতাংশ কমে ২১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ দেওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এতে সেপ্টেম্বর মাসে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে বের হয়ে ২ শতাংশের কিছু বেশি ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এ মাসে এনবিআর রাজস্ব আদায় করে ২৮ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের রাজস্ব কমানোর পরও অক্টোবর মাস নাগাদ ৮.৬৯ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়। অক্টোবর মাসে এনবিআর এর রাজস্ব আদায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪ মাসে রাজস্ব আদায় হয় এক লাখ এক হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম