উন্নয়ন খাতে বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে লুটপাট করেছে আ.লীগ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৪ পিএম
দেশের বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, যা পুরো এডিপির ৪১.৩ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় করেছে দুই লাখ ২৯ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।
এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের পরও সড়ক ও বন্দরের মান সন্তোষজনক নয়। দৃশ্যমান উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে তৎকালীন সরকার। পর্যাপ্ত সমীক্ষা ছাড়াই ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহলকে সুবিধা দিতে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্প এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বড় উদাহরণ কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা সেতুতে রেল লাইন প্রকল্প। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প যাতে বাস্তবায়ন না হয় সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। টেকসই ও জনবান্ধব উন্নয়ন করতে হবে।
শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) ও চাইনিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ (সিইএবি) যৌথভাবে আয়োজিত ‘সংস্কার ও টেকসই উন্নয়নের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিএসআরএফের সাধারণ সম্পাদক মাসউদুল হকের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি ফসিহ উদ্দীন মাহতাব। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটির শিক্ষক ড. একেএম আতিকুর রহমান। বক্তব্য রাখেন রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. সারদার শাহদাত আলী, সিইএবির প্রধান উপদেষ্টা কি চাংলিয়াং, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. শারমিন নিলোর্মি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা ও মো. মাহিন সরকার প্রমুখ।
অবকাঠামো উন্নয়নে বিগত সরকারের ব্যাপক অনিয়মের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ভবিষ্যতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প নেওয়া হবে, জনবান্ধব প্রকল্প নেওয়া হবে। তিনি বলেন, এই সরকারের কাছে জনগণের আকাঙ্ক্ষা আকাশচুম্বী। আমাদের একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নিতে হয়েছে। সরকারের কোষাগারে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই। আমাদের সংস্কারের কথা বলছেন, কিন্তু সময় বেশি নেই। আমরা চাচ্ছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেমন আমার আগের যে পেশা শিক্ষকতায় জড়িত ছিলাম, সেখানে ফিরে যেতে চাই।
তিনি আরও বলেন, এই সরকারের সঙ্গে অন্য সরকারের পার্থক্য রয়েছে। অন্য সরকার যখন আসে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসে। নির্বাচন করতে টাকা লাগে, মাসল পাওয়ার লাগে। আমাদের তা করতে হয়নি। আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। শিক্ষার্থীরা বলেছেন যে দায়িত্বটা নেন, এজন্য আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। আমরা কায়েমি স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধ নই। এক হাজারের বেশি শহিদ হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগের প্রতি আমরা দায়বদ্ধ, যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতিও দায়বদ্ধ।
মো. সারদার শাহদাত আলী বলেন, উন্নয়নের প্রায় ৯৯ শতাংশ চাপিয়ে দেওয়া হয়। ওই কারণে ওইসব প্রকল্প থেকে মানুষের যে উপকার হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। সামনে থেকে যেসব প্রকল্প নেওয়া হবে তার কর্মপরিকল্পনা করছি। জনমানুষের মতামত নিয়ে ওই কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি ড. আকতার মাহমুদ বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাওড়ে সড়ক নির্মাণ, পানির স্রোতের বিপরীতে রেললাইন নির্মাণ, সঞ্চালন নেটওয়ার্ক না করে দাশেরকান্দি পানি শোধনাগারের মতো ভুল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সঠিক সমীক্ষা না করায় প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বারবার বেড়েছে। এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা গেছে।
ড. শারমিন নিলোর্মি বলেন, গ্রামীণ জনপথে যেসব অবকাঠামোও রক্ষণাবেক্ষণে জোর দেওয়ার দরকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, ২০০৫-০৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, তবে তা টেকসই উন্নয়ন না। উন্নয়নের নামে কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ভয়াবহ লুটপাট করা হয়েছে। উন্নয়নের সঙ্গে অন্যান্য বিভাগের সমন্বয় করার কাজ শেখ হাসিনার সরকার করেনি। তার ওই ধরনের সদিচ্ছাও ছিল না। তার ইচ্ছা ছিল কিছু অবকাঠামো দেখাবে, কিছু ভবন দেখাবে, কিছু কালভার্ট ও সেতু দেখাবে। এটা দেখিয়ে ব্যাপক লুটপাট করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিগত দিনে যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে দেশের উপযোগী করে ব্যবহার করা যায় তা ভাবা দরকার।
আরেক সমন্বয়ক মো. মাহিন সরকার কর্নফুলী টানেলের অব্যাহত লোকসানের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য তা কতটুকু ভ‚মিকা রাখবে। তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দেওয়া ঋণের বোঝা সরানোর দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। সামগ্রিক অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার আগে দরকার প্রশাসনকে কার্যকর করা ও জনগণের প্রশান্তি আনার জন্য যেসব উদ্যোগ আছে সেগুলো নেওয়া। এসব উদ্যোগ নেওয়া না হলে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিপূর্ণভাবে সুনিশ্চিত হবে না। আর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আশা করছি, আমাদের সামগ্রিক সহায়তায় সরকার উতরে যেতে পারবে।