জুলাই-আগস্ট গণহত্যা
সাবেক ১২ মন্ত্রী-উপদেষ্টাসহ ২০ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৪ পিএম
গ্রেফতার সাবেক ১০ মন্ত্রী, দুই উপদেষ্টাসহ ২০ জনকে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আদেশে সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, বিচারপতিসহ ১৪ জনকে আগামী ১৮ নভেম্বর এবং ছয়জন সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাকে ২০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ১৭ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন এই আদালত। তাদের গ্রেফতার করে আগামী ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করে রোববার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল পৃথক এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
বিষয়টি জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এদিকে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গুম হওয়া ৩৯ পরিবারের সদস্যরা রোববার ট্রাইব্যুনালে পৃথক অভিযোগ দায়ের করেছেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই নিয়ে ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৫০টি গুমের অভিযোগ করা হয়েছে বলে প্রসিকিউশন জানিয়েছে।
১৮ নভেম্বর যে ১৪ জন : গ্রেফতার সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফারুক খান, ড. দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জুনাইদ আহমেদ পলক, কামাল আহমেদ মজুমদার, তৗফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সালমান এফ রহমান, সাবেক বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে ১৮ নভেম্বর হাজির করার আদেশ দেন আদালত।
২০ নভেম্বর যে ৬ জন : গ্রেফতার সাবেক পুলিশপ্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুলাহ আল মামুন, বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক ঢাকা জেলা এসপি আব্দুল্লাহ হিল কাফী, সাভার থানার ওসি আবুল হাসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম, আরাফাত হোসেনকে ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে।
আদেশের পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আজকের এই ট্রাইব্যুনালে তিনটি আবেদনপত্র উপস্থাপন করেছি। তার একটি ছিল আগে যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল এবং এর বাইরেও যারা এই মামলার অভিযুক্ত, এ রকম বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর জন্য দুটি আবেদন করেছি আলাদাভাবে। সেই আবেদনে মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেছেন এবং তাদের এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। একটি আবেদনে ১৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন। দ্বিতীয়টিতে ছয়জনকে গ্রেফতার দেখানোর জন্য আবেদন করা হয়েছিল। তারা বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়ে হাজতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ায় গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন করা হয়েছিল এবং আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। তাদের ২০ নভেম্বর এই আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর। তৃতীয় আরেকটি আবেদনে ১৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য করা হয়েছিল। আদালত পর্যালোচনা করে সেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এই ১৭ জনের সবাই পুলিশ কর্মকর্তা। তারা যেন পালিয়ে যেতে না পারেন, সে কারণে সবার নাম বলা সম্ভব হচ্ছে না। যার ১ নম্বরে আছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। তাদের গ্রেফতার করে আগামী ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাসহ যারা গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের নাম আমরা ধারাবাহিকভাবে সবার সামনে নিয়ে আসব। হয়তো এখানে একটু সময় লাগবে। কিন্তু কোনো দোষীকে বাদ দেওয়া হবে না। অথবা কোনোভাবে প্রভাবিত হয়ে, অপরাধ করেছে এমন কোনো ব্যক্তিকে ছাড় দেওয়া হবে না। এই দুটো মেসেজ আমরা জাতির উদ্দেশে জানাতে চাই।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার সব মামলার বাদী হবেন চিফ প্রসিকিউটর। আমাদের কাছে জনগণ বা ভিকটিম পরিবার যেসব নিয়ে আসেন, এগুলো শুধু তথ্য। এই তথ্যগুলোকে তদন্ত সংস্থা গ্রহণ করে, পরে পর্যালোচনা করে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়। সেই রিপোর্ট চিফ প্রসিকিউটরের কাছে দেওয়া হলে, চিফ প্রসিকিউটর কোর্টের কাছে আবেদন করেন অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য। আজ পর্যন্ত তিনটি মিসকেস করা হয়েছে। প্রথম মিসকেসের মধ্যে শেখ হাসিনা এবং দ্বিতীয় মিসকেসে ওবায়দুল কাদেরসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের এবং তৃতীয় মিসকেসে পুলিশ সদস্যদের আওতায় নেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, প্রথম যখন এই মামলা করা হয়েছে আমরা অপরাধীদের নাম প্রকাশ করিনি। যাতে তারা কেউ পালিয়ে যেতে না পারে।
প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে উলেখ করে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য তাদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এপিসি ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের হত্যা করা হয়েছে। শুধু হত্যাই করা হয়নি, লাশগুলোকে বিকৃত ও গুম করা, জানাজার নামাজ পড়তে না দেওয়া, ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করতে না দেওয়াসহ যত মানবতাবিরোধী অপরাধ আছে তারা সেগুলো করেছেন।
ট্রাইব্যুনালে আরও ৩৯টি গুমের অভিযোগ দায়ের : এদিন ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গুম হওয়া ৩৯ পরিবারের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালে গুমের পৃথক অভিযোগ দায়ের করেছেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই নিয়ে ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৫০টি গুমের অভিযোগ করা হয়েছে বলে প্রসিকিউশন জানিয়েছে। এ সময় প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ, গাজী এম এইচ তামিমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ গুম পরিবারের প্রধান সমন্বয়ক বেল্লাল হোসেন জানান, ৩৯টি অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক তিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আসা গুম পরিবারের সদস্য টঙ্গীর মোরসেদা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তার স্বামী ফারুক হোসেন টিটুকে ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে টঙ্গী রেলস্টেশন এলাকা থেকে র্যাবের পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। অদ্যাবধি তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। স্থানীয় র্যাব অফিসে স্বামীর সন্ধানে গেলে তারা বিভিন্ন টালবাহানা করেন।