বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন পাঁচ দফা দাবি করছে?
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৫ পিএম
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলসহ মঙ্গলবার পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের যে জায়গা থেকে শেখ হাসিনার সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলো, সেখান থেকেই আবার ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে’ স্থায়ীভাবে নির্মূল করতে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
মঙ্গলবার এ প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়েছে অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহকে। বুধবার এসব দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সময় দিয়েছে বলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে জানিয়েছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
একইসঙ্গে এ সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে স্থায়ীভাবে নির্মূল’ না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। তবে সংগঠনটির এসব দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যে কেউ যে কোন দাবি জানাতে পারে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে, সেসব দাবির পেছনে জনসমর্থন কতটা রয়েছে, সেটা বিবেচনা করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন ঘোষিত আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ শহীদ মিনারে যেসব দাবি জানিয়েছেন সেগুলো হলো:
বাহাত্তরের সংবিধানকে অনতিবিলম্বে বাতিল করে সেই জায়গায় চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের পক্ষ থেকে নতুন করে সংবিধান লেখা।
এ সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে এই সপ্তাহের মধ্যে পদচ্যুত করা।
জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের ‘স্পিরিটের আলোকে’ এই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে ‘প্রক্লেমেশান অব রিপাবলিক’ ঘোষণা।
গত তিনটি নির্বাচন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা।
এসব নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এসব দাবি ঘোষণার সময় শহীদ মিনারে হাসনাত আব্দুল্লাহ আরো বলেন, আমাদের বিপ্লব শেষ হয়ে যায় নি। আমরা পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে পারলেও এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে পারিনি। বিগত ১৬ বছর বিএনপি, জামায়াত, শিবির, ছাত্রদলের নেতাদের নির্যাতিত হতে দেখেছি। যতদিন পর্যন্ত সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে আমরা ভালো পরিবেশ করে দিতে না পারছি ততদিন পর্যন্ত আমাদের বিপ্লব শেষ হবে না।
‘প্রক্লেমেশান অব রিপাবলিক’ কী?
শিক্ষার্থীদের চার নম্বর দাবিতে ‘জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের আলোকে’ চব্বিশ পরবর্তী বাংলাদেশ তৈরির জন্য এই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে ‘প্রক্লেমেশান অব রিপাবলিক’ ঘোষণার কথা বলা হয়েছে।
এ সংগঠনের একজন অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ জানান, চব্বিশের বিপ্লবের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা চাওয়া হয়েছে। আমাদের চব্বিশের যে বিপ্লবটা হয়েছে এ বিপ্লবের স্বীকৃতিটা আমরা চাচ্ছি। প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক চাচ্ছি। যেটার মাধ্যমে সংবিধানকে বাতিল করে পুরো কলাকানুনকে এ প্রক্লেমেশনের আন্ডারে নিয়ে আসা হবে।
এই প্রক্লেমেশনের উপরে ভিত্তি করেই চব্বিশ পরবর্তী দেশ পরিচালনা করা হবে বলে জানান মাসুদ।
তিনি বলেন, সকল দল মত ধর্ম বর্ণের মানুষ সকল দলের প্রতিনিধিরা আওয়ামী লীগ ব্যতীত ফ্যাসিবাদী শাসক এবং তার অংশীদার ব্যতীত বাকি সকলে এখানে স্বাক্ষর করবে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক। তারা পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসলে প্রক্লেমেশনের উপর ভিত্তি করেই মূলত দেশটাকে চালাবে, এরকম চাচ্ছি আমরা।
বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল দাবির বিষয়টিকে মাসুদ ব্যাখ্যা করেন এভাবে যে, এর ফলে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ৫৪ বছরে ফ্যাসিবাদী শাসন, সামরিক শাসকসহ নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এ সংবিধানকে ‘ভাইরাস’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা মনে করি এটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা নতুন সংবিধান চব্বিশের ছাত্র – জনতা যেভাবে চাচ্ছে সকল স্টেকহোল্ডার,অংশীদারদের সাথে কথা বলে নতুন একটা সংবিধান রচনার কথা আমরা বলতেছি। যার ফলে কেউ ফ্যাসিস্ট বা অটোক্রেট হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না।
‘প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক একটিই’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন পাঁচ দাবির মধ্যে চারটি দাবি নিয়ে এর আগে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেকেই এগুলো চান না। বাহাত্তরের সংবিধান নিয়েও অনেক আগেই প্রশ্ন উঠেছিলো।
পাঁচ দাবির মধ্যে চারটা দাবি নিয়ে এর আগেই অনেক আলোচনা হয়েছে। সেখানে মোটামুটি বোঝা গেছে অনেকে এগুলো চান না। বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে তো অনেক আগেই প্রশ্ন উঠেছে। যারা বাহাত্তরের সংবিধান বানিয়েছিলেন তারাই এতোবার এটা কাঁটা-ছেঁড়া করেছেন যে এটার আর কিছু নাই।
কিন্তু ‘প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ দাবির বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের একটিই ‘প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’।
আমরা জানি যে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল একটা রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়েছিল আমাদের। স্বাধীনতার ঘোষণা-পত্রে ছিল। প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক একটিই। সেই রিপাবলিকটি কর্তৃত্ববাদী শাসকের কারণে গত পাঁচ দশকে ফাংশন করেনি ভালোভাবে। তবে এর দায় শাসকদের।
‘রিসেট বাটন’ প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ করে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সমালোচনা পরবর্তী সময়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যে ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করা হয় নি। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ যদি থাকে তাহলে তো ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রও থাকে। সেটা বাহাত্তরের সংবিধানেরও আগে। সেটার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ ও হয়েছিল, একটা সরকারও হয়েছিল ওই সময়। সুতরাং সেখানে একটা রিপাবলিক ঘোষণা হয়েছিল। পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ বলা হয়েছিল।
এখন হঠাৎ আরেকটা রিপাবলিক ঘোষণা করতে হলে তো, রাষ্ট্রের গোড়া ধরে টান দিলে তো বিস্তারিত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে এই সংগঠনের নেতারাই রয়েছে, ফলে তারাই ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করলে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
‘প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ দাবির মাধ্যমে বিপ্লবের স্বীকৃতি কেন তাদের লাগবে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, তারা বিপ্লবের স্বীকৃতি চায় কেন? তারা যদি বিপ্লব করে থাকে তারাই তো বিপ্লবী সরকার। কে কাকে স্বীকৃতি দিবে? তারাই তো সরকারে রয়েছে।
তাদের দাবি অনুযায়ী পাঁচই আগস্টকে ‘বিপ্লব দিবস’ পালন করলেই চলে বলে মন্তব্য করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি মনে করেন, বর্তমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে সরকারে আন্দোলনকারীদের কয়েকজনও রয়েছে। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান প্রক্লেমেশনের দাবি প্রসঙ্গে বলেন, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনভাবে দলীয় সিদ্ধান্তে এই ধরনের দাবি প্রকাশ করেনি। ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোও তো সার্বজনীন হলে যুক্ত হবে। প্রক্লেমেশন যখন করবেন, তখন তো সেটি সার্বজনীন হতে হবে। অন্যান্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো এখনো পর্যন্ত পাবলিকলি এই দাবিগুলোর সাথে একমত হয়েছে কীনা সেটাও একটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের প্ল্যাটফর্মটির ভেতরেই এখন মতাদর্শগত পার্থক্য স্পষ্ট থাকায় এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দাবি দাওয়া বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক জোবায়দা নাসরীন এবং রাশেদা রওনক খান।
তারা বলছেন দাবি সার্বজনীন হতে হলে সেখানে সব শ্রেণি-পেশার, সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের মধ্যে যে মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে সেগুলো খুব দৃশ্যমান। এই দৃশ্যমান মতাদর্শগত পার্থক্য কাটিয়ে তারা একটা প্ল্যাটফর্মে এসে কথাগুলো বলছেন নাকি মতাদর্শগত পার্থক্যের জায়গাটা এখনো রয়ে গেছে, তা পরিষ্কার নয়।
কারণ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে তারাই একমত না সবাই, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বক্তব্য দিচ্ছেন। অন্যান্য যে আরো চারটা দাবির ক্ষেত্রেও তাইই হবে। অতএব সামগ্রিকভাবে আসলে এই দাবিটা কতটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেই পাটাতন থেকে করা হচ্ছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন অধ্যাপক জোবায়দা নাসরীন মনে করছেন, জনসমর্থন ছাড়া শুধুমাত্র চাপ প্রয়োগ করে কোন দাবি বাস্তবায়ন করা যায় না।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটা মব তৈরি করে পদত্যাগ চাওয়া বা এটাই করতে হবে এরকম চাওয়া আমি মনে করি এটা একভাবে বিপ্লবের স্পিরিটকে খারিজ করে। কারণ বিপ্লবের স্পিরিটের মূল জায়গাই কিন্তু জনগণের শক্তি। ফলে যে দাবিই তারা করুক তা বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মত বা জনসমর্থন অবশ্যই দরকার হবে।