হাসিনার চাচা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়েও ছিলেন ২৩ প্রতিষ্ঠানের পদে
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৩ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
শারীরিকভাবে অক্ষম। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। এরপরও ক্ষমতার প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ ২৩ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার শীর্ষপদে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন। এসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একাধিক বিমা কোম্পানি, সেবা খাতের সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসোসিয়েশন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের বোর্ড মিটিংয়েও নিয়মিত অংশ নিতে পারেননি তিনি। কিন্তু তার নাম ভাঙিয়ে এবং কখনো ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে সরকারি নানা সুবিধা পেয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি। আবার কোনো কোম্পানি দখল করার পর তাকে সামনে রাখা হয়েছে।
এসব কোম্পানির নেপথ্যে মালিকানায় ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এবং সরকারের সুবিধা নেওয়া একাধিক ব্যবসায়ী। এসব সংস্থার মূল কাজেও একধরনের স্থবিরতা ছিল। কিন্তু বিশেষ সুবিধা নিতে তাকে সামনে রাখা হয়। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি নিজেও সুবিধা নিয়েছেন। এছাড়াও একই সময়ে একাধিক তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক আবার অন্য একাধিক তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন, বিদ্যমান আইনে যা সাংঘর্ষিক। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বলছে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। একই সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক এবং অন্য কোম্পানির স্বতন্ত্র হওয়ায় বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৮২ বছর বয়সি শেখ কবির হোসেন শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো ভাই। সে হিসাবে শেখ হাসিনার চাচা। এছাড়াও গোপালগঞ্জ জেলা সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনি। এ পরিচয়েই তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে ছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন কোম্পানি, সংস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন মিলিয়ে ২৩টি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে ছিলেন শেখ কবির। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) চেয়ারম্যান, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান, সরকারি ন্যাশনাল টি কোম্পানির চেয়ারম্যান, কাবিকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কাবিকো ফুড লিমিটেড অ্যান্ড মাসুদা ডায়েরি নিউট্রিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বেস্ট হোল্ডিংয়ের (লা মেরিডিয়ান হোটেল) স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান, ইসলামী আই হাসপাতালের ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য, হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর দ্য লোকাল আন্ডার প্রিভিলেজড পিপলসের চেয়ারম্যান এবং খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
জানতে চাইলে শেখ কবির হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। শুধু ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনে নাম রয়েছে। এখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন করছেন। তারা আমাকে বলেছেন, ‘আপনি বার্ষিক সাধারণ সভা পর্যন্ত থাকেন। না হলে আগে একটি নির্বাচন দিতে হবে।
শেখ কবির বলেন, আমি শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। হাঁটাচলা করতে পারি না। ফলে অবসর নিয়েছি। তিনি বলেন, জীবনে অনেক করেছি। সারা জীবন এগুলোই করে বেড়িয়েছি। অনেক প্রতিষ্ঠানে ছিলাম। এখন আর সক্ষমতা নেই।
শেয়ারবাজারে সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান সিডিবিএল। এই প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় শেয়ারবাজারের তথ্যভান্ডার। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ কবির। কিন্তু চেয়ারম্যান থাকলেও বোর্ড মিটিংয়ে নিয়মিত আসতেন না। ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সাবেক পরিচালক নুরুল ফজল বুলবুল। এ সময়ে সিডিবিএলের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, শেয়ারের তথ্য পাচার এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে জালিয়াতির অভিযোগ আসে। এসব বিষয় নিয়ে একাধিক রিপোর্ট করেছে যুগান্তর। পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পেয়েছে বিএসইসি। বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করা শেয়ারবাজারের অন্যতম আরেকটি প্রতিষ্ঠান সরকারি ন্যাশনাল টি কোম্পানি। সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সহযোগিতায় এ প্রতিষ্ঠানটি দখল করে নেয় বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। এরপর শেখ কবিরকে চেয়ারম্যান বানানো হয়। এক্ষেত্রে নাফিজ সরাফাতসহ গোপালগঞ্জের ৬ জন পরিচালক ছিলেন। এরপর এমডিকে বের করে দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক লুটপাট করেছে চক্রটি। এর ফলে লাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটি ৫ বছরে ২২৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে ব্যাপক সমালোচিত এবং অত্যন্ত বিতর্কিত কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৯ সালে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন ছিল জালিয়াতিতে ভরপুর। এই কোম্পানির মালিক অর্থ পাচারের দায়ে অভিযুক্ত আমিন আহমেদ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় বর্তমানে তিনি কারাগারে। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাত। প্রথমে তালিকাভুক্তি আটকে দেন বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। পরবর্তী সময়ে সালমান এফ রহমানের হস্তক্ষেপে বিভিন্ন পক্ষের সমঝোতা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিতে শেখ কবিরকে স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়। আবার শেখ কবিরের প্রতিষ্ঠান কাবিকো লিমিটেডকে ২ লাখ প্লেসমেন্ট দেয় বেস্ট হোল্ডিংস। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এই পরিমাণ শেয়ার ৭০ লাখ টাকায় কিনতে হয়েছে। সুবিধা নিয়েছেন সালমান এফ রহমান, শিবলী রুবাইয়াত, সদ্য বরাখাস্ত হওয়া সেনা কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর সাবেক কোয়ার্টার মাস্টার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মুজিবুর রহমান। নিজ নামে, স্ত্রী এবং ছেলের নাম মিলিয়ে ৫ লাখ ৪৬ হাজার শেয়ার নিয়েছেন মুজিব। এছাড়াও সুবিধা নিয়েছেন সাবেক মুখ্যসচিব নজিবুর রহমান এবং সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদকে। প্রতিষ্ঠানটি তালিকাভুক্তির সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা ছিল চোখের পড়ার মতো।
শেয়ারবাজারে বিমা খাতের শীর্ষ কোম্পানি ছিল ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানির হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের পাহাড় গড়েন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। বিষয়টি নিয়ে ২০২১ সালে যুগান্তরে সংবাদ ছাপা হলে পর্ষদ ভেঙে দেন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এরপর প্রতিষ্ঠান দখলে নেন সালমান এফ রহমান। কিন্তু চেয়ারম্যান করা হয় শেখ কবির হোসেনকে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার গ্রাহক পাওনা টাকার জন্য বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকদের ২ হাজার কোটি টাকার উপরে পাওনা রয়েছে।
এছাড়া বিমা মালিকদের সংগঠন ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনে ১৪ বছরের বেশি সময় সভাপতি ছিলেন শেখ কবির। ২০১১ সালে তিনি এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বে আসেন। শেখ হাসিনার পতনের পর বিদায় নেন। তার দোয়া ছাড়া এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআর-এর (ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি) চেয়ারম্যান ও সদস্যপদে নিয়োগ পাওয়া কঠিন ছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ করেন শেখ কবির।
এছাড়াও শেখ কবির গোপালগঞ্জ জেলা সমিতির সভাপতি, রিজেন্ট বোর্ড অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, ন্যাশনাল সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সদস্য, ন্যাশনাল কনজুমার রাইট প্রোটেকশন কাউন্সিলের সদস্য, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য, বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য এবং ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ছিলেন।