এলপিজি আমদানি: ৮ মাসে ২২শ কোটি টাকা পাচার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪৯ এএম
ফাইল ছবি
বিদেশ থেকে কম দামে এলপিজি আনলেও বেশি দামে বিক্রি করছে কয়েকটি কোম্পানি। শুধু তাই নয়, ইরাকের কথা বলে ইরান থেকে এই জ্বালানি আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত ৮ মাসে এই প্রক্রিয়ায় ২২শ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার তাগিদ দিয়েছে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ইরানি দুটি জাহাজে এলপিজি আমদানি করা হয়। জানা গেছে, চট্টগ্রামের একটি শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সুকৌশলে ইরান থেকে অবৈধভাবে দুই জাহাজে এলপিজি আমদানি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এই অভিযোগ তুলেছে। সম্প্রতি নৌপরিবহণ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে এই অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পাঁচ সদস্যের একটি টিম জাহাজ দুটি পরিদর্শনও করেছে। লোয়াবের অভিযোগ-সংঘবদ্ধ একটি চক্র গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দুই লাখ ৫৬ হাজার ২৫২ টন এলপিজি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্র থেকে অবৈধভাবে আমদানি করেছে। এর মাধ্যমে ১৭৫ মিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের ওই বহুল বিতর্কিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে অবৈধ এলপিজি আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। ইতঃপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়গুলো জানানো হলেও পাত্তা দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
জাহাজ দুটির নাম উল্লেখ করে এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) অভিযোগ করে, চট্টগ্রামের ওই গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্র ইরান থেকে অবৈধভাবে এলপিজি আমদানি করে বাজারজাত করছে। ইরান থেকে আমদানি করা এলপিজি প্রথমে ইরাকে পাঠানো হচ্ছে এবং পরবর্তী সময়ে ইরাকি বন্দর থেকে পণ্য লোডের তথ্য প্রদর্শন করে বাংলাদেশে আমদানি করছে। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জিওয়াইএমএম নামের একটি জাহাজকে এই অবৈধ আমদানির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিওয়াইএমএম নামের যে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছিল তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর (আইএমও নম্বর: ৯১৩৯৬৯৬) এবং জে টাইগার নামে অন্য একটি জাহাজের রেজিস্ট্রেশন নম্বরও একই। এই জাহাজে ইরাক থেকে ২০ হাজার ১০০ মেট্রিক টন এলপিজি ইরাকের খর আল জুবায়ের বন্দর থেকে লোডিং দেখিয়ে আমদানি করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের বিল অব এন্ট্রি এবং ইমপোর্ট জেনারেল মেনুফেস্ট (আইজিএম)সহ বিভিন্ন কাগজপত্রের কপি প্রমাণ হিসাবে অভিযোগপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া গ্যাজ জিএমএস কার্গো নামের পানামার জাতীয় পতাকাবাহী একটি ভেসেল (আইএমও নম্বর ৯১৩১৫৩৯) এলপিজি ট্যাঙ্কার নিয়ে গত ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে আসে এবং জাহাজ থেকে জাহাজে স্থানান্তরের মাধ্যমে এলপিজি স্থানান্তর করে। এর আগে এটি ৮ আগস্ট থেকে এক মাস ইরানের একটি বন্দরে অবস্থানের পর ৮ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ বন্দরে নোঙর করে।
ইরান মার্কিন-নিষেধাজ্ঞা আরোপিত একটি দেশ হওয়ায় সেখান থেকে এলপিজি আমদানির বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গ্যাজ জিএমএস জাহাজটিকে আটক করলেও শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ছেড়ে দেয়।
ক্যাপ্টেন নিকোলাস নামে আরও একটি কার্গো জাহাজও ইরান থেকে সরাসরি বাংলাদেশে এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন নথি থেকে দেখা গেছে যে তানজানিয়ার পতাকাবাহী ক্যাপ্টেন নিকোলাস আইএমও নম্বর ৯০০৮১০৮ সহ এলপিজি কার্গো নিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ইরানের খোরমশার বন্দর ছেড়ে আসে।
ইরান থেকে আমদানি করা এলপিজি এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এই গ্যাসের কোনো গন্ধ নেই। ফলে গ্যাস লিকেজ হলে গ্রাহক তা বুঝতে পারে না। ফলে এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী আমদানি করা এলপিজি তে অবশ্যই গন্ধ থাকতে হবে।
অথচ ইরাকের বসরা গ্যাস কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জানায়, তারাই একমাত্র অনুমোদনপ্রাপ্ত ইরাকি কোম্পানি যেটি উম কাসর পোর্টের মাধ্যমে এলপিজি রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু তারা রপ্তানির জন্য জেওয়াইএমএম জাহাজে কোনো এলপিজি লোড করেনি। এছাড়া তারা খর আল জুবায়ের বন্দর থেকেও রপ্তানির জন্য কোনো এলপিজি লোড করেনি। ইরাকের বসরা গ্যাস কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নিশ্চিতকরণের সার্টিফিকেটও চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্র থেকে আমদানি করা এলপিজির প্রধান উপাদান প্রোপেন ও বিউটেনের (গন্ধ) সঠিক সংমিশ্রণ না থাকায় গুণগত মানে ত্রুটি থাকে, যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে আমদানিকৃত এলপিজিতে অবশ্যই গন্ধ মিশাতে হয়। যাতে রান্নাঘরে কোনো কারণে লিক হলে টের পাওয়া যায়। ইরান থেকে আমদানিকৃত এলপিজিতে গন্ধের সঠিক ব্যবহার থাকে না বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া অবৈধ এবং নানা অনিয়মের মাধ্যমে একটি চক্র এলপিজি আমদানি করায় বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।
এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী স্বাক্ষরিত পত্রটি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানকারী জাহাজ জে ওয়াইএমএম এবং ক্যাপ্টেন নিকোলাস নামের জাহাজ দুটিতে অবৈধভাবে আমদানিকৃত এলপিজি রয়েছে। ঘটনাটি তদন্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মেম্বার হারবারের নেতৃত্বে একটি টিম বহির্নোঙরে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার জাহাজ দুটি পরিদর্শন করে এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি অভিযোগপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, একটি টিম জাহাজ দুটি পরিদর্শন করে এসেছে। তবে এ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
লোয়াবের তথ্যমতে, দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার বেড়েছে। গৃহস্থালি, বাণিজ্যিক এবং শিল্পকারখানায় গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এলপিজি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত এলপিজি বোতলজাত করে দেশব্যাপী বাজারজাত করা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ এলপিজি ইর্স্টর্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত হয়। চাহিদার বাকি অংশ তুরস্ক, কাতার এবং আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে বাজারে দেওয়া হচ্ছে।