Logo
Logo
×

জাতীয়

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা

বেশিরভাগ মৃত্যু হচ্ছে শক সিনড্রোমে

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৬ পিএম

বেশিরভাগ মৃত্যু হচ্ছে শক সিনড্রোমে

ডেঙ্গু জ্বরের আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগই শক সিনড্রোম উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। শক সিনড্রোম হলে রোগীর শরীরে অতি দ্রুত রক্তচাপ ও রক্তে অনুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায়। শরীরে তরল ব্যবস্থাপনার (ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট) জটিলতা দেখা যায়। 

পানিশূন্যতা তৈরি হয়। এ কারণে অনেকে অচেতন হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি বেশি জটিল হওয়ায় অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও হেমোরজিক ফিবার দুই ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগী আসছে। 

গত বছরের মতো এবার শক সিনড্রোমের রোগী বেশি মনে হচ্ছে। বেশিরভাগ শক সিনড্রোম রোগী আসছে ঢাকার বাইরে থেকে। যাদের অধিকাংশই আবার প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত। তবে শক সিনড্রোম বা হেমোরজিক যে উপসর্গ দেখা দিক না কেন রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ২০৭ নম্বর। এই ওয়ার্ডের মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা যায় সাড়ে ৩ বছরের শিশু ইসমাইলকে। তার হাতে লাগানো ক্যানোলা, চলছে স্যালাইন। সঙ্গে প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছে ছোট্ট শরীর। দুটি কাঁথা দিয়ে তার মা মরিয়ম বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মা ছেলের মাথায় বারবার হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কখনো ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিচ্ছেন, কখনো ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে মাঝেমধ্যে নার্সদের ডেকে সন্তানের সমস্যার কথা শোনাচ্ছেন।

জানতে চাইলে ডিউটিরত দুজন চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, শিশুটি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। কিন্তু জ্বর আসার পর শুরুতে অভিভাবকরা বুঝতে পারেননি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হওয়ায় এখানে নিয়ে আসছে। দেরি করে হাসপাতালে আসায় শক সিনড্রোম উপসর্গ দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের বিশেষায়িত ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ৩২ নম্বর শয্যায় ভর্তি সাড়ে ৩ বছর বয়সি জুরাইন ইয়াসারকে কোলে নিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন মা সাদিয়া পারভিন। কিন্তু ছোট্ট শিশুটি কোনোভাবেই ওষুধ খেতে চাচ্ছিল না। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে ছেলের জ্বর। জ্বর আসার একদিন পরেই ডেঙ্গু টেস্ট করালে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। বাড়িতেই সেবা দিচ্ছিলাম। তারপরও জ্বর ১০২-১০৩ ডিগ্রিতে উঠানামা করছিল। তৃতীয় দিনে ফের ডেঙ্গু টেস্ট করানোর পর পজিটিভ ধরা পড়ে। ততক্ষণে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়। হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসকরা জানান ছেলে শকে চলে গেছে। তবে কয়েকদিনের চিকিৎসা শেষে এখন অনেকটা ভালোর দিকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু ঢাকা মেডিকেল বা শিশু হাসপাতাল নয়, রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মহাখালী কোভিড ডেডিকেটেড ডিএনসিসি হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতাল সবখানেই ডেঙ্গু রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। শয্যা সংকটে কোনো কোনো হাসপাতালে এক বিছানায় দুজন শিশু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা ছোট-বড় সব বয়সি রোগীর বেশিরভাগই শক সিনড্রোমে ভুগছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের পর সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে জ্বর সেরে যায়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই জটিল পরিস্থিতিগুলো হলোÑডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। 

হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে রোগীর চোখে রক্ত জমে যায়। নাক, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত ঝরে; মুখ, কান, মলদ্বার এরকম যে কোনো একটি বা একের অধিক অংশ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। বমি ও কাশির সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে। তাই এই সময়ে জ্বর হলে কোনোভাবেই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ বা হাসপাতালে নিয় আসতে হবে।

ঢামেকের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো সাইফুল্লাহ বলেন, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যারাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক ফিভারে (অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ) ভুগছিলেন। অনেক সময় এ ধরনের রোগীদের বাঁচানো চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। আমাদের এখানে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ছাড়া অন্যান্য লক্ষণ নিয়ে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গতবারের চেয়ে কিছু ভিন্ন উপসর্গ নিয়েও রোগী ভর্তি হচ্ছে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী মশা কামড়ানোর চার থেকে সাত দিন পর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ স্পষ্টভাবে দেখা দেয়। এই সময়ে বিরামহীন মাথাব্যথা, হাড় ও হাড়ের পেশিতে তীব্র ব্যথা, বমি ভাব, বমি হওয়া, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, সারা শরীরের ফুসকুড়ি, চোখের পেছনে ব্যথা, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচণ্ড পেটব্যথা, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। কখনো মস্তিষ্কের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে পারে। এরকম উপসর্গ দেখলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে কোনোভাবেই প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।

শিশুদের ডেঙ্গুর বিষয়ে সর্তক থাকার পরামর্শ দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. লুৎফুন নেছা বলেন, শিশুর জ্বর হওয়ার প্রথম দিনেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মৌসুমি জ্বর ভেবে অবহেলা করা মোটেই উচিত নয়। দেরি হলেই লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে শিশু সংকটজনক পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। জ্বরের পাশাপাশি বমি বমি ভাব, পাতলা পায়খানা থাকতে পারে শিশুর। জ্বর পরবর্তী সময়ে শিশুর শরীরে লালচে র‌্যাশ উঠাও ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ। তাই চিকিৎসকের সন্দেহ হলে প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই ডেঙ্গু এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ডেঙ্গু শনাক্ত করানো যায়।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফারহানা আহমেদ স্মরণি বলেন, দিনে ও রাতে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। এডিস মশার লার্ভা জš§ নিতে পারে এমন স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নিয়মিত বাসার আশপাশে স্প্রে করতে হবে। শিশুদের ফুলহাতা পোশাক পরিয়ে রাখাসহ হাতে-পায়ে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে।

২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ৫৮৩, মৃত্যু তিন: এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতালে আরও ৫৮৩ জন ভর্তি হয়েছেন। এতে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪০৫ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন তিন ডেঙ্গু রোগী। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৯ জনে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি রোগীদের মধ্যে একজন ঢাকায়, একজন বরিশালে ও একজন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ২৪৬ জন রয়েছেন। এছাড়াও ঢাকা বিভাগে ১৬৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২২ জন, বরিশাল বিভাগে ৬২ জন, খুলনা বিভাগে ২৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৭ জন এবং রংপুর বিভাগে ৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। 

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৪০ হাজার ৪০৫ জন। যাদের মধ্যে ৬৩ দশমিক ৩০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী। এছাড়া এখন পর্যন্ত মৃত ১৯৯ জনের মধ্যে ৫০ দশমিক ৩০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৯ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম