Logo
Logo
×

জাতীয়

বিচারাধীন ৬ লাখ: থমকে আছে চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারও

Icon

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০১ পিএম

বিচারাধীন ৬ লাখ: থমকে আছে চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারও

বাম থেকে: নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন, ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী জাহান রাফি, বুয়েটের আবরার ফাহাদ, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ ও টেকনাফে মেজর সিনহা হত্যা

নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণ হন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজন। এ ঘটনার তিনদিন পর তাদের মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। আলোচিত এ ঘটনার মামলা দায়েরের প্রায় তিন বছর পর ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ ও র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এরপর উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। প্রসঙ্গত, তারেক সাঈদ তৎকালীন সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর জামাতা।

নিম্ন ও উচ্চ আদালতের পর ছয় বছর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আটকে আছে। শুধু এ মামলা নয়, এমন অর্ধশতাধিক চাঞ্চল্যকর মামলা সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আপিল বিভাগে এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসামিদের সাজা, বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাচ্ছে না। বছরের পর বছর তাদের থাকতে হচ্ছে কারাগারের কনডেম সেলে। প্রয়োজনের তুলনায় বিচারক, অবকাঠামো সংকটসহ নানা কারণে মামলাজট থেকে মুক্তি মিলছে না বিচার বিভাগের। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এসব মামলা শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

অতিরিক্ত অ্যাটার্নি জেনারেল অনিক আর হক বলেন, চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু মামলা শুনানির অপেক্ষায় আছে। এগুলো শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সুপ্রিমকোর্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আপিল বিভাগে মামলা বিচারাধীন ২৭ হাজার ৮৬টি, যা ২০১৯ সালে ছিল ২১ হাজার ৮১৩টি। আর বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলা ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯২৬টি, যা ২০১৯ সালে ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৬৬৪টি। হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে ১০১৯টি ডেথ রেফারেন্স, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭৭৫টি।

একাধিক আইনজীবী জানান, সাধারণত বছর ও মামলার ক্রমানুসারে ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) শুনানি হয়ে থাকে। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়। ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য হাইকোর্টে কয়েকটি বেঞ্চ রয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের রিভিউ, পিলখানা হত্যা, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, শিশু রাজিব ও রাকিব হত্যা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল পুনরুজ্জীবিত চেয়ে করা আবেদন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির কয়েকটি ধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা আপিল এবং মেয়ের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলা।

হাইকোর্টে নুসরাত জাহান রাফি হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, হোলি আর্টিজান হামলা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান হত্যা ও রমনা বটমূলে বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অপেক্ষায় থাকা নিহতের আত্মী য়স্বজন হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিচার নিয়ে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এসব চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এত বিপুলসংখ্যক চাঞ্চল্যকর মামলা আটকে থাকাটা উদ্বেগজনক। বিচারক ও বেঞ্চ বাড়িয়ে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

আবরার ফাহাদ হত্যা : ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স এবং মামলার নথি হাইকোর্টে আসে। এরপরই আসামিরা দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন। হাইকোর্টে এখনো সেই আপিল শুনানি হয়নি। ৬ অক্টোবর আবরার হত্যার ৫ বছর অতিবাহিত হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আবরার হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির প্রস্তুতির অংশ হিসাবে পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে। এটি হাইকোর্টে শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ এসএম শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সগুলো বছর অনুযায়ী সিরিয়ালি শুনানি হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হয়ে থাকে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল শুনানি করে দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মো. খসরুজ্জামান বলেন, আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এসব মামলা বিচারিক আদালত শেষে এখন সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন। এসব মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছেন বিচারপ্রার্থীরা। দ্রুত মামলাগুলো শুনানির উদ্যোগ নেওয়া দরকার। রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি অপেক্ষমাণ। তবে এগুলো শুনানির জন্য কোনো নির্দেশনা এ মুহূর্তে দুদক থেকে আসেনি।

বিশ্বজিৎ দাস হত্যা : ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর সকালে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা ওই হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ রায় দেন। বিচারিক আদালতের রায়ে ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল, চারজনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন এবং অপর দুজনকে খালাস দিয়ে ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেন, তারা খালাস পেয়েছিলেন। আসামিদের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। পরে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া খালাসের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। সেই আবেদনের এখনো শুনানি হয়নি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম