ড. ইউনূস-আনোয়ার ইব্রাহিম বৈঠক
ব্যবসা-বিনিয়োগ বাড়িয়ে সম্পর্ক জোরদারে একমত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৪ পিএম
বিমানের টিকিট স্বল্পতাসহ সংকটময় পরিস্থিতির কারণে নির্ধারিত সময়ে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা শ্রমিকদের যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে সহায়তা পাবেন ১৮ হাজার শ্রমিক। পর্যায়ক্রমে আরও বাড়বে। ঢাকা সফরকালে শুক্রবার ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি। এ সময় তিনি জানান, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। তারা বাংলাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সংবাদ সম্মেলনে উভয় নেতা ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়িয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে একমত প্রকাশ করেন।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, তার সরকার জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে কাজ করছে। এ কাজে মালয়েশিয়াকে পাশে চান। এর আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বৈঠক করেন দুই দেশের সরকার প্রধান। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ড. ইউনূস ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ এবং আগের সরকারের নৃশংসতার কথা সংক্ষেপে তুলে ধরেন। মালয়েশিয়ার সরকার প্রধানও সব ধরনের সহায়তা এবং পূর্ণ সমর্থন জানান। ড. ইউনূস বলেন, বৈঠকে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও মানবিক বিষয় আলোচনা হয়েছে।
ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে একদিনের সফরে শুক্রবার ঢাকা এসেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম। ওই দিন দুপুর ২টায় আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে দেশটির ৫৮ সদস্যদের প্রতিনিধিদল হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তাকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এটিই বাংলাদেশে বিদেশি কোনো সরকার প্রধানের প্রথম উচ্চপর্যায়ের সফর। আনোয়ার ইব্রাহিমেরও এটি প্রথম বাংলাদেশ সফর।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রথমে ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেন। এ সময় সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টা ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মালয়েশিয়ার সহায়তা কামনা করা হয়। পাশাপাশি আসিয়ান কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশকে একটি ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার বিষয়ও উত্থাপন করা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বেশকিছু বিষয় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে-অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শ্রম অভিবাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অন্যতম।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনের পর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। সংক্ষিপ্ত সফর শেষে সন্ধ্যা ৬টায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে এই সফর নিয়ে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হবে।
আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মানুষের মর্যাদা রক্ষায় ড. ইউনূসের ভূমিকা আমরা জানি। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি চার দশক থেকে চিনি। তাই তার ওপর ভরসা রাখছি। বাংলাদেশের বন্ধু হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংকটময় পরিস্থিতির জন্য যারা মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি প্রথম দফায় এমন ১৮ হাজার কর্মপ্রত্যাশীদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কর্মীরা আধুনিক দাস নয়। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব মালয়েশিয়ার। এ সময় বাংলাদেশে যেসব মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। আনোয়ার ইব্রাহিম আরও বলেন, আমাদের দেশে আরও জনশক্তি প্রয়োজন। তবে উভয় দেশের মধ্যে শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এছাড়া সেমি কন্ডাক্টর, ডেটা সেন্টার, এআই, নিউ টেকনলোজির বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমাদের অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সেন্টার রয়েছে, যা সামাজিক ব্যবসা এবং ড. ইউনূসের তিন শূন্যের ধারণা প্রচার করে। আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছি। একমত হয়েছি তারুণ্যের শক্তি ব্যবহার করে সামনে এগোনোর বিষয়ে। তার মতে, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। এসবের মূল লক্ষ্য দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।
ড. ইউনূস বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে চাই। দুই দেশই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। তাছাড়া, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিষয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনশক্তি রপ্তানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আলাপ হয়েছে কর্মসংস্থান তৈরি এবং ভিসা সহজীকরণের বিষয়েও। ড. ইউনূস বলেন, বৈঠকে তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। এগুলো হলো-রাজনৈতিক, মানবিক, বাণিজ্যিক দিক। মালয়েশিয়ার সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে কথা বলেছি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, সাত বছর আগে ১২ লাখ রোহিঙ্গা এসেছিল। বর্তমানে সেটি আরও বেড়েছে। এখনও প্রতিদিন চারশ থেকে পাঁচশ রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। তিনি বলেন, গত ৭ বছরে রোহিঙ্গাদের নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে। এক্ষেত্রে ২০১৭ সালে যেসব শিশু জন্ম নিয়েছিল, বর্তমানে তাদের বয়স ৭ বছর। এসব শিশু জানতে পারছে, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এসব হতাশা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলতে পারে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তবে এটির সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। ড. ইউনূস বলেন, এই সংকট শুধু বাংলাদেশই নয়। মালয়েশিয়াও ভুক্তভোগী। এটি নিরসনে একসঙ্গে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন আঞ্চলিক জোটকে এতে সম্পৃক্ত করার কথাও জানান তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, আনোয়ার ইব্রাহিম তার ৪০ বছরের বন্ধু। পুরোনো বন্ধুকে ঢাকায় স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুবই খুশি। বৈঠকে ড. ইউনূস ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব, ছাত্র ও জনগণের আত্মত্যাগ এবং বিগত সরকারের সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর নেতাদের সঙ্গে তার দীর্ঘ সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন। দুই নেতা তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে একই গাড়িতে চড়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের ভেন্যুতে যান।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মালয়েশিয়ার নানা অবদান রয়েছে। এগুলো হলো- রেমিট্যান্স, রপ্তানি, আমদানি এবং বিদেশি বিনিয়োগ। বর্তমানে মালয়েশিয়া বাংলাদেশে অষ্টম শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগ ৮৩ কোটি ২৭ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করেছে ৩৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার। মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৪৫ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানির বিবেচনায় চীন ও ভারতের পরেই তৃতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়া। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ (ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট) বা মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটি সম্ভব হলে মালয়েশিয়ার বাজার বাংলাদেশিদের জন্য আরও সম্প্রসারিত হবে। শুল্কমুক্ত পণ্যের কোটা বাড়বে।
এছাড়া মালয়েশিয়াসহ আসিয়ান অঞ্চলে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে মালয়েশিয়া চাইলে ভূমিকা রাখতে পারে। দেশটির বাজারে যেসব পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো হলো-কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, লজিস্টিক এবং হালাল পণ্য। এছাড়াও শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ নানাবিধ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি মালয়েশিয়ার কোম্পানি বাংলাদেশে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এখন শিক্ষাসহ আরও বিনিয়োগে আগ্রহী। এছাড়া চিকিৎসাসেবা গ্রহণে মালয়েশিয়া একটি পছন্দের গন্তব্য হতে পারে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়া এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানের পরবর্তী চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছে। ফলে আসিয়ানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়াও আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আসিয়ানে বাংলাদেশকে ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার বিষয়টিও বিশেষভাবে উত্থাপন করা হয়েছে।