প্রকাশ্যে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ আরাফাতের নয়া অপকর্ম
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২২ পিএম
আরাফাত, সরাফাত ও শওকত-দুর্নীতি আর অনৈতিক ফায়দা হাসিলে যেন একই বৃন্তে তিনটি ‘ফুল’। ক্ষমতার প্রভাববলয়ে প্রস্ফুটিত হওয়া এ ‘ফুল’ সুবাস নয়, ছড়িয়েছে দুর্গন্ধ। মোহাম্মদ আলী আরাফাত ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী। ক্ষমতার অন্দরে থেকে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটে ধনকুবের বনে গেছেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী এ দুজনকে নিয়ে কোম্পানি খুলে নিয়েছেন ব্যবসায়িক সুবিধা। ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনজনের সখ্য এবং যৌথ নামে খোলা কোম্পানির নথিপত্রসহ দালিলিক বেশকিছু তথ্যপ্রমাণ এসেছে যুগান্তরের হাতে। তা থেকেই পাওয়া গেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শওকত আলী চৌধুরী বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে আরাফাত ও সরাফাতকে নানা সুবিধা দিয়েছেন। জামানত ছাড়া পার্সোনাল গ্যারান্টিতে দেওয়া হয়েছে অঢেল টাকার ঋণ। বিনিময়ে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দাপট দেখিয়েছেন শওকত। বিশেষ করে পুঁজিবাজার, জাহাজ ভাঙা শিল্প, ব্যাংক ও বিভিন্ন চা বাগানে নিজের ব্যবসা বিস্তৃত করেছেন অস্বাভাবিক গতিতে। বাগিয়ে নিয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদনও। জাহাজ ভাঙা শিল্পে অব্যবস্থাপনার জেরে একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও থেকেছেন অধরা। এক্ষেত্রে আরাফাত ও সরাফাতকে নিজের ‘রক্ষাকবজ’ হিসাবে ব্যবহার করেছেন শওকত। আরাফাত ও সরাফাতের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তারা এই তিনজনের যোগসাজশের তথ্য পেয়েছে। সংগ্রহ করছে তিনজনের যৌথ কোম্পানির নথিপত্র। দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে-শওকতকে নানা সরকারি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়াই যৌথ কোম্পানির শেয়ার হাতিয়ে নেন আরাফাত ও সরাফাত। এরপর সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম ভাঙিয়ে আইটি খাতের ওই কোম্পানিতে বিপুল অঙ্কের টাকার কাজ নেওয়ার ছক আঁটেন। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর তারা সরকারি কোন কোন প্রকল্পের কাজ নিয়েছেন, সেই নথিপত্র সংগ্রহ করবে দুদক।
জানা যায়, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই আত্মগোপনে চলে যান সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানেই দুদক কর্মকর্তারা শওকতের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানির আড়ালে নানা দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের তথ্য পেয়েছেন। তবে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান অবস্থায়ই ২৩ সেপ্টেম্বর দেশ ছেড়ে সপরিবারে পালিয়ে গেছেন নাফিজ সরাফাত। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ইকে-৩৭৩ ফ্লাইটে তার দেশত্যাগের ছবিও পেয়েছেন এ প্রতিবেদক। একসময় ব্যাংক কর্মকর্তা হিসাবে চাকরি করা সরাফাত ক্ষমতার দাপটে পুলিশ এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় পদ্মা ব্যাংক দখলে নিয়ে বনে গিয়েছিলেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। শেয়ারবাজার থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা লুটের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেইসের মালিকানায় যুক্ত তিনি। এছাড়া তার মোবাইল টাওয়ার কোম্পানি, পাওয়ার প্ল্যান্ট, তারকা হোটেল ব্যবসা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরাফাতের পালিয়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেলেও আরাফাতের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে গুঞ্জন আছে, তিনিও অতিগোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তাদের মোবাইল ফোনে কল করেও বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে এখনো দেশ ছাড়েননি শওকত।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে শনিবার শওকত আলী চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্য চেয়ে একই নম্বরে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সময় চাইলেও তিনি জবাব দেননি।
যুগান্তরের হাতে আসা তথ্য-উপাত্ত ও নথিপত্রে দেখা যায়, সিডিনেট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড নামের কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার মোহাম্মদ আলী আরাফাত, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও শওকত আলী চৌধুরী। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সিডিনেটের অফিসে হামলা চালায়। প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করা হয় সিডিনেট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড। শুরুতে এ কোম্পানির ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তার মালিকানাধীন স্ট্রেটেজিক ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং এবি হাইটেক কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে তিনি এ শেয়ার ধারণ করেন। আর ওয়েব ইন্টেলিজেন্স লিমিটেডের মাধ্যমে মোহাম্মদ এ আরাফাত ধারণ করেছেন ২০ শতাংশ শেয়ার। রহস্যজনক কারণে চলতি বছরের মার্চে নিজেদের মধ্যে শেয়ার পুনর্বণ্টন করা হয়। ২৪ মার্চ নাফিজ সরাফাত তার হাতে থাকা শেয়ারের ৩০ শতাংশ শওকত আলী চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করেন। তার মালিকানাধীন জারান অব ডক লিমিটেড এই ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে। রেজিস্ট্রার্ড অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সিডিনেট কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের অনুমোদিত মূলধন ১০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি টাকা। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ধরা হয়েছে ১০ টাকা করে। কোম্পানিটি প্রযুক্তি খাতে ব্যবসা পরিচালনা করে। এ কোম্পানিকে তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে অনৈতিক ফায়দা হাসিলের ছক করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, সিডিনেট কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এই অল্প সময়ে ব্যাপক নাড়াচাড়া হয়েছে। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সিডিনেটের মোট শেয়ারের সংখ্যা ১০ লাখ। এর মধ্যে ওয়েব ইন্টিলিজেন্সের শেয়ারের পরিমাণ দুই লাখ। কোম্পানিটিতে সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের স্ত্রীকে পরিচালক হিসাবে দেখানো হয়েছে। কোম্পানিটির চার লাখ শেয়ার রয়েছে স্ট্র্যাটেজিক ফিনান্স লিমিটেডের হাতে। সিডিনেটে এ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে আছেন মো. শরীফুল ইসলাম, নাফিজ সরাফাত ও এহসানুল কবির। অপরদিকে জারা অফডক লিমিটেড সিডিনেটের তিন লাখ শেয়ার ধারণ করে। কোম্পানিটির প্রতিনিধি হচ্ছেন শওকত আলী চৌধুরী ও জারান আলী চৌধুরী। এছাড়া রাহিব সাফওয়ান ও সরাফাত চৌধুরীর নামে সিডিনেটের এক লাখ শেয়ার রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে শওকত আলী চৌধুরী নিজেকে সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এবং সরাফাতের বলয়ে যুক্ত করেন। এতে নিজে যেমন সুবিধা নিয়েছেন, তেমনই ওই দুইজনকে সুবিধা দিয়েছেন। আরাফাত ও সরাফাতের তদবিরে ২০২২ সালেই ‘নামরীন পাওয়ার লিমিটেড’ নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদনও পেয়ে যান শওকত। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানায় শওকত আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বেরিন ও মেয়ে জারা নামরীনের নাম রয়েছে।
জানা যায়, শওকত আলী চৌধুরী তার ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতে আরাফাত ও সরাফাতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করেছেন। এ কৌশলে তিনি বিগত সময়ে ব্যাপক ব্যবসায়িক সুবিধা নিয়েছেন। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি করেও তিনি এবং তার পরিবার বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছেন। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পথে বসে যান। সেখানেও এসেছে শওকত আলী চৌধুরীর নাম। শেয়ারবাজার ধসের ওই ঘটনা তদন্তে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শওকত আলী চৌধুরীর স্ত্রী তাসমিয়া আম্বেরিন এবং মেয়ে জারা নামরীনের নাম ছিল। তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে এ দুজনের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পায়। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাসমিয়া আম্বেরিনের বিও অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়। কিন্তু সরকারের প্রভাবশালী মহলের তদবিরে ছাড় পান শওকত। তখন থেকেই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে।
আরও জানা যায়, ক্ষমতার দাপটে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শওকত আলী চৌধুরী বছরের পর বছর জাহাজ ভাঙা শিল্প ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। তার মালিকানাধীন এসএন করপোরেশনে ১৫ বছরে ১৩টি দুর্ঘটনায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এত দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ প্রভাব খাটিয়ে এসএন করপোরেশনের পরিবেশ ছাড়পত্রের মান সবুজে উন্নীত করেছিলেন তিনি। সবশেষ ৭ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডে অবস্থিত ওই শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার সময় বিস্ফোরণে ৬ জন দগ্ধ হয়ে মারা যান। এ বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশগত ছাড়পত্র স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ রাখতে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। নোটিশে বলা হয়েছে, এসএন করপোরেশন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে বারবার দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটলেও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে মালিকপক্ষ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মারাত্মক এ ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনোরূপ তদারকির ব্যবস্থাও নেই। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এস হাসানুল বান্নার সই করা নোটিশ অব ডিমান্ড ফর জাস্টিসে দাবি করা হয়, এসএন করপোরেশনের জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডের সব কার্যক্রম বন্ধ করে আদালতের নির্দেশ এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এস হাসানুল বান্না যুগান্তরকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে বারবার দুর্ঘটনায় হতাহতের পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে দায়ীরা পার পেয়ে গেছেন। তবে এবার জড়িতরা যাতে পার না পান, সে বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।