বাদ যাচ্ছে রামু-গুনদুম রেললাইন নির্মাণ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যেও রয়েছে কম গুরুত্বের প্রকল্প। রাজনৈতিক বিবেচনা বা আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রকল্প নেওয়ায় এখন এ ধরনের প্রকল্প গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। ফলে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। তেমনি একটি প্রকল্প ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ।’
এই প্রকল্প থেকে বাদ যাচ্ছে রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণকাজ। ফলে বেঁচে যাচ্ছে ৬ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এজন্য প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। আজ বুধবার প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় উপস্থাপন করা হচ্ছে প্রস্তাবটি। পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠেয় সভায় সভাপতিত্ব করবেন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সোলেমান খান। সভায় বিভিন্ন কার্যক্রমের বাস্তবায়নসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
প্রকল্পটির বিষয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, কক্সবাজার গুনদুম প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। কেননা তখন বলা হয়েছিল এটি বাস্তবায়ন করা হলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো গুনদুমের ওপারে মিয়ানমারে শুধু পাহাড়ি এলাকা। সেখানে ওপারে রেললাইন তৈরির কোনো পরিকল্পনাও নেই। তাহলে এত টাকা ব্যয় করে অপরিকল্পিত প্রকল্প নেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে রামু-গুনদুম অংশের জন্য অর্থায়ন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এছাড়া মিয়ানমারে যে সংঘাতময় অস্থির পরিস্থিতি চলছে সেখানে ট্রান্স এশিয়ান রেল সংযোগ স্থাপন আপাতত সম্ভব নয়। এজন্য সরকারের নিজস্ব তহবিলের বিপুল অঙ্কের ব্যয় করে গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করাটা যৌক্তিক হবে না। এটা বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৮১৫ কোটি ৪৭ লাখ এবং এডিবির ঋণ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। সেই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তবে এবার দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ না বাড়লেও ব্যয় ৬ হাজার ৬৮২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কমিয়ে মোট ১১ হাজার ৩৫১ কোটি ৬২ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২ হাজার ৭১২ কোটি এবং এডিবির ঋণ থেকে ৮ হাজার ৬৩৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। ফলে ব্যয় কমছে ৩৭ দশমিক ০৬ শতাংশ।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, যখন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল তখন পরিকল্পনায় ভুল ছিল এটা ঠিক কথা নয়। ওই সময়ের চিন্তা ছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওই অংশ দুটির মধ্যে রেল সংযোগ তৈরি করা। এছাড়া মিয়ানমারের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে সেটি আগে ছিল না। সম্প্রতি হয়েছে। আবার চিরস্থায়ীভাবে যে এমন পরিস্থিতি থাকবে সেটিও বলা যায় না। আশা করা যায় পরিস্থিতি এক সময় ভালো হবে। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ট্রেড রিলেশন এখনো সচল আছে। তবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যদি অর্থায়ন করতে না চায় সেক্ষেত্রে আমাদের ফিরে আসা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু প্রথম কারিগরি এবং আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কোনো ত্রুটি ছিল কিনা সে বিষয়ে রেলওয়েকে পরিকল্পনা কমিশন প্রশ্ন করতে পারে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, সর্বশেষ অনুমোদিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) দোহাজারী থেকে কক্সবাজার এবং রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত মোট ১২৮ কিলোমিটার ভূমি অধিগ্রহণসহ রেল ট্র্যাক নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণসহ ২৮ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক নির্মাণ অংশ বাদ দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে কিনা সেটি নিয়ে পিইসি সভায় প্রশ্ন করা হবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।
এছাড়া সংশোধিত ডিপিপিতে নতুন ৮টি ফুটওভার ব্রিজ, কক্সবাজারে বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের ক্যাপাসিটি ৬০০ কেভিএ থেকে ২০০০ কেভিএ-তে উন্নীতকরণ এবং লেভেলক্রসিং গেটের পরিবর্তে ৪৬টি সড়ক আন্ডারপাস নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। আরও আছে নতুন করে ৪টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, প্ল্যাটফর্ম শেডের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিসহ নতুন প্ল্যাটফর্ম শেড নির্মাণ, কক্সবাজার রেলওয়ে রেস্ট হাউজ দোতলা থেকে ৫ তলায় উন্নীতকরণ অঙ্গ অন্তর্ভুক্তি। এসব অঙ্গের কাজ ইতোমধ্যে বাস্তবায়নও করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর কাজ শুরুর আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়েছে কিনা এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হবে পিইসি সভায়। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রস্তাবিত সংশোধিত ডিপিপিতে যেসব কাজের ভ্যারিয়েশনের প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলোর ভ্যারিয়েশন প্রস্তাব কোন পর্যায়ে অনুমোদন করা হয়েছে তার প্রমাণকসহ রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চাওয়া হবে।