প্রাথমিক ও মাধ্যমিক
পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি এখনো চূড়ান্ত হয়নি
হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ পিএম
ফাইল ছবি
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে আর সাড়ে ৩ মাস সময় বাকি। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি ও টেন্ডার প্রক্রিয়া। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, মে-জুনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রুফ রিডিং করা হয়। তবে এবার শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর চলতি মাসের শুরুতে আসে বই সংশোধনের ঘোষণা। আগামী শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে কী কী সংশোধন ও পরিমার্জন করা যায়, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। এ বছর স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৩৪ কোটি বিনামূল্যের বই ছাপানোর কথা। মুদ্রণসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের মতো টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে বছরের শুরুতে কিছু বই পৌঁছানো সম্ভব হলেও সব বই ছাপা শেষ হতে মার্চ পর্যন্ত সময় লাগবে।
বিগত সরকারের আমলে এনসিটিবির কিছু অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে নিম্নমানের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপানোর কাজ দেওয়া হতো। এতে বইয়ের মান ও ছাপা নিয়ে বেশ বিতর্ক ওঠে। এবারও এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান বিতর্কিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছেন। এর মধ্যে অগ্রণী প্রেস অন্যতম। তাদের ছাপানো বই এত নিম্নমানের যে শিক্ষাবর্ষের ৬ মাসও টেকেনি। পৃষ্ঠাগুলোও অনেক পাতলা হওয়ায় শিক্ষার্থীরা উলটাতে গিয়ে প্রায় সব বই ছিঁড়ে গেছে। এবারও তারা প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আরও কয়েকটি বিতর্কিত প্রেসের কাজ পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকে ৯ কোটি বই আর মাধ্যমিকে ২৫ কোটি বই শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ছাপানো হবে। নতুন কারিকুলামে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয় পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আগামী শিক্ষাবর্ষে কারিকুলাম পরিমার্জন ও সংশোধন হলে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা বাড়বে। এর ফলে বইয়ের ফর্মার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে এবং ছাপাতেও সময় বেশি লাগবে। বিতর্কিত ও নিম্নমানের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে ভালোমানের অধিকসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হলে দ্রুত বই ছাপানো সম্ভব। এতে সময় কম লাগবে। যথাসময়ে বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো যাবে। এতে খরচও কমবে। এজন্য স্বনামধন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বিতর্কিত প্রেসের টেন্ডার বাতিল করে দ্রুত এ প্রক্রিয়া শেষ করার কথা জানান তারা।
শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ২৩ দিনের মাথায় নতুন শিক্ষাক্রম বা জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তাই ২০২৫ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করে ২০২৬ সাল থেকে তা পরিপূর্ণরূপে কার্যকর করা হবে। এর আগে ২০২৫ সালে শিক্ষার্থীদের জন্য পূর্বের ২০১২ সালের প্রণীত সৃজনশীল কারিকুলাম ধাঁচের পাঠ্যবই বিতরণ করা হবে। এতে পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন ও সংশোধন করে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ের কোনো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। এসব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের।
এছাড়া অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সৃজনশীল কারিকুলামের বই থাকবে বলে খসড়া হলেও এসব বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে কন্টেন্টে নানা পরিমার্জন করা হবে। আর নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে বিভাগ বিভাজন। এতে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ আবার চালু হওয়ায় বাড়ছে বইয়ের সংখ্যাও।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, চলতি মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগের শিক্ষাক্রমের আদলের শিক্ষায় ফিরে গিয়ে ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য চলমান শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বার্ষিক পরীক্ষার সিলেবাস ও প্রশ্ন ধরন তৈরি করা কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম। একই সঙ্গে আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর কার্যক্রমও অব্যাহত ছিল। এখন পাণ্ডুলিপি সংশোধন ও পরিমার্জন নিয়ে কাজ চলছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এই পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ শেষ হবে। এরপর ছাপানোর কাজ শুরু হবে। পাশাপাশি বই ছাপানো ও স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়িত্বে যারা থাকবেন, তাদের সমন্বয় জরুরি। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই পৌঁছাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। মুদ্রণসংশ্লিষ্টরা সচেষ্ট হলে এ সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব।
বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান যুগান্তরকে বলেন, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য যারা টেন্ডার পেয়েছেন, তারা যথাসময়ে বই দিতে পারবেন না। এনসিটিবির সাবেক বিতর্কিত কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন তদবির করে তারা এই ছাপানোর কাজ পেয়েছেন। তাই বছরের শুরুতে বই দিতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। এছাড়া প্রতিবছর কিছু প্রেস যথাসময়ে বই দেয় না। এনসিটিবির হাতে এখন পর্যাপ্ত সময় নেই। তাই বেশি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে হবে। তাহলে দ্রুত কাজ শেষ হবে। এছাড়া কারিকুলামের যে সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ রয়েছে, তা দ্রুত শেষ করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়া সময়মতো শেষ করতে পরিমার্জনের পাশাপাশি পাণ্ডুলিপি দ্রুত সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত করার পরামর্শ মুদ্রণশিল্প সমিতির এ নেতার।
বৃহস্পতিবার বই বাঁধাই শিল্পে সিন্ডিকেট বিলুপ্ত করাসহ তিন দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতি। দীর্ঘদিন ধরে তারা কর্মক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতা-উত্তর জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক বোর্ড বই টেন্ডারের মাধ্যমে তালিকাভুক্তি অবস্থায় বই বাঁধাই করে আসছেন। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তাদের এ সংগঠনটিকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে একচেটিয়াভাবে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন বলেও অভিযোগ করেন তারা।
এনসিটিবি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের শুরতেই শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এনসিটিবি ভবন পরিদর্শন করেন। সেসময় এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে সম্প্রতি কারিকুলাম সংশোধন সংক্রান্ত যে পরিপত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয় জারি করেছে, সেটি সংশোধন করে পুনরায় প্রকাশ করার কথা জানিয়েছেন। বৈঠক সূত্র জানায়, শিক্ষাক্রম সংশোধনসহ দরপত্র বাতিলের বিষয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর জানিয়েছিলেন, আগামী বছরের বই দৃষ্টিনন্দন হবে। জানুয়ারিতে সব পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এবারের বইগুলো দেখতে দৃষ্টিনন্দন হবে, কাগজ ভালো হবে। এক্ষেত্রে কোনো আর্থিক অনিয়ম হবে না। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘পরীক্ষা দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এবার আমাদের হাতে সময় খুব কম। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।’