Logo
Logo
×

জাতীয়

জিম্মি ফল ব্যবসায়ীরা

আমদানির আড়ালে জিল্লুর-সিরাজুল সিন্ডিকেট

Icon

কায়েস আহমেদ সেলিম

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ পিএম

আমদানির আড়ালে জিল্লুর-সিরাজুল সিন্ডিকেট

ফাইল ছবি

রাজধানীর বাদামতলী। বিদেশি ফল আমদানির প্রাণকেন্দ্র। এখানকার সাধারণ ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অল্প টাকায় বিদেশি ফল দেশের মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া। তবে বিগত প্রায় দেড় দশকে সাধারণ আমদানিকারকদের মাথায় হাত জিল্লুর চেয়ারম্যান ও সিরাজুল ইসলাম সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।

ফল আমদানিকারক হাজি রহমত বলেন, ২০২২ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ভিটামিন ‘সি’র চাহিদা মেটাতে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে আমরা আমদানি করি অন্তত ৬০ কনটেইনার মাল্টা। যা ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছলে ক্রেতারা মাত্র দেড়শ টাকা কেজিতে কিনতে পারবেন। তবে বেয়াই হাজি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সে ফল আটকা পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে। এই সুযোগে সিন্ডিকেটের মজুত রাখা মাল্টা বাজারে ছেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি করা হয় ৪৫০ টাকা দরে। এতে সর্বস্বান্ত হয়ে ফলের বাজার ছাড়তে হয় রহমতদের। এখন টুকটাক ব্যবসা করেন টুকরিতে ফল নিয়ে।

বাদামতলীর আরেক ব্যবসায়ী বলেন, বেয়াই হাজি সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা ও হাজি সেলিমের একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুচর জিল্লুর চেয়ারম্যান ও সিরাজুল ইসলাম। তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব এখনও বহাল আড়ত এলাকায়।

সিরাজুল ইসলাম নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন ফল আমদানি-রপ্তানিতে সহায়তাদানকারী ব্যাংকগুলো। তার এই কাজে নেপথ্য সহযোগী আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলমের একজন নিকটাত্মীয়।

বিভিন্ন সময় ওই আত্মীয়ের সহায়তায় ঋণপত্র খোলায় জটিলতা, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও শুল্ক বাড়ানোর অজুহাতে বিপাকে ফেলা হয় ব্যবসায়ীদের। এ সময় ওভার ইনভয়েসে এলসি খুলতে বাধ্য করে ১ টাকার ফল দশ টাকা দেখিয়ে বিদেশে পাচার করা হয় মুদ্রা।

অভিযোগ রয়েছে, এই কাজ সহজতর করতে সিরাজুল ইসলাম নিজেই খেজুর বাগান কিনেছেন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। মাল্টা, কমলা ও আপেল বাগান আছে ভারত, ভুটান, নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশে।

সেকান্দার নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিবেশী দেশের এসব বাগান থেকে চোরাই পথে ফল ঢোকে দিনাজপুর, হিলি, জয়পুরহাটসহ আশপাশের জেলায়। যেখানে এই সিরাজুলের নামে-বেনামে হিমাগার বা ফল সংরক্ষণাগার আছে অন্তত ৮০ থেকে ৮৪টি। এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, পাচার হওয়া টাকা দিয়ে শুধু দুবাই, আবুধাবি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় কেনা হয়েছে অন্তত ২৪টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। এই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বছরের ব্যবধানে কমলা, মাল্টা, আঙুর ও আপেলের দাম বেড়েছে কেজিতে ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশের বাজারের ৬০-৬৫ শতাংশ ফল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। কয়েক বছর আগে দেশের ফলের বাজার ছিল আমদানি করা বিদেশি ফলের দখলে। তবে ডলার সংকটের পাশাপাশি কাস্টমস শুল্কহার বাড়িয়ে দেওয়ায় সেই আমদানি করা ফলের বাজারে ধস নেমেছে।

দেশে কৃষি পণ্য আমদানির ছাড়পত্র দিয়ে থাকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, দেশের সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ভুটান, মিসর, ব্রাজিল, তিউনিশিয়া, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফ্রান্স থেকে ফল আমদানি করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন ফল আমদানি করা হয়।

২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ৫ লাখ ৬ হাজার টন। আমদানি কম হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার টন।

এছাড়া, জুলাই ২০২২ থেকে নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ৫ মাসে ১ লাখ ৫৮ হাজার টন ফল আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফল আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা এক লাখ ৬২ হাজার টন।

আর ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ এর নভেম্বর পর্যন্ত কমলা আমদানি করা হয়েছে ৪১ হাজার ৮৯২ টন, মাল্টা ৩০ হাজার ২২ টন, আপেল ৫৬ হাজার ২৭৭ টন ও আঙুর ২৫ হাজার ৪০৭ টন। আমদানি কম হওয়ার কারণে চাহিদার শীর্ষে থাকা আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুরের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

বিভিন্ন ফলের বাজারে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ২০২২ সালে আপেলের কেজি ছিল ১৭০-১৮০ টাকা। সেটা এখন ২৬০-২৭০ টাকা। বছরের ব্যবধানে বেড়েছে কেজিতে ৮০-৯০ টাকা। কমলা ছিল ১৫০-১৬০ টাকা কেজি। এখন ২৪০-২৬০ টাকা। বেড়েছে ৯০-১০০ টাকা। মাল্টার কেজি ছিল ১৬০-১৭০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ২৬০-২৭০ টাকা। বেড়েছে ১০০ টাকা। আর আঙুরের দাম ছিল ৩৫০-৩৬০ টাকা কেজি। এখন ৪৪০-৪৫০ টাকা। কেজিতে বেড়েছে ৯০ টাকা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বেয়াই হাজি সিন্ডিকেট কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে আমদানি করা বিদেশি ফলের ওপর শুল্কহার বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ কাজে লাগায় সুবিধাভোগীরা। কর বাড়ানোর আগেই আমদানি করা ফল সেই সুযোগে বাজারে ছেড়ে বেশি দামে বিক্রি করে অস্থির করে তোলে ফলের বাজার।

আগে প্রতি কেজি আপেল, কমলা ও মাল্টায় ৬২ টাকা শুল্ক আদায় করা হলেও এখন তা ঠেকেছে ৮৮ টাকায়। একইভাবে ৯৮ টাকার আঙুরের শুল্কহার ১১৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বিদেশি ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩ শতাংশ, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। এছাড়া এসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে চায় না ব্যাংকগুলো। সেই সঙ্গে আছে অন্যান্য ভ্যাট ও কর। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে এলসির নামে অর্থ পাচার করে এই সিন্ডিকেট।

ঢাকা মহানগর ফল ব্যবসায়ী ও আড়তদার সমিতির বর্তমান সভাপতি মো. হারুন বলেন, বাংলাদেশে ‘ফ্রেশ ফ্রুটস’ ও ‘ড্রাই ফ্রুটস’ এই দুই ক্যাটাগরিতে প্রায় ৫২টির মতো ফল আমদানি করে। শুল্ক না কমলে এসব ফলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ফল আমদানির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়েছে। এতে আমরা ফল আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে যদি কাস্টমস কর কমানো হয়, তাহলেই সাধারণ মানুষ বাজার থেকে ফল কিনতে পারবে। আর সেটি না হলে ফলের দাম নিু ও মধ্যবিত্তের নাগালে আসবে না। অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্তদের মোবাইলে এসএমএস ও কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম