বিশেষজ্ঞদের অভিমত
হেনস্তার জন্য মামলা দেওয়া উচিত নয়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ এএম
প্রতীকী ছবি
গণহারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। সাংবাদিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। আইনজীবীদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা হচ্ছে। এসব মামলা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে বর্তমানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে মামলা হতে পারে। কিন্তু হেনস্তার জন্য কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া উচিত নয়।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, গণপিটুনি, মাজার ভাঙচুর, ফ্যাক্টরিতে আগুন এবং আদালতে আসামিদের ওপর আক্রমণ, আইনশৃঙ্খলা, আইনের শাসন ও সভ্যতার পরিপন্থি। বুধবার যুগান্তরকে দেওয়া পৃথক সাক্ষাৎকারে তারা এসব কথা বলেন।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি সারা দেশে মব ট্রায়াল তথা ক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক মানুষকে হেনস্তা বা হামলার ঘটনার বিস্তার ঘটেছে। মব ট্রায়াল কোনো ট্রায়াল (বিচার) নয়, এটি সমাজের কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই ট্রায়ালের মাধ্যমে এমনকি ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে। কিছু মানুষ একত্র হয়ে এসব ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, এসব করে বঙ্গবন্ধু, সাত বীরশ্রেষ্ঠসহ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। মাজার ভাঙা হচ্ছে। এমনকি হাজারো শ্রমজীবী মানুষের কর্মক্ষেত্র গাজী টায়ার্স, প্রাণ-আরএফএলের তিনটি প্লান্টসহ অগণিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে; লুটপাট করা হয়েছে। এগুলো এখনও থামেনি। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তেমনি দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, রাজশাহীতে ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাকেও মব ট্রায়াল করে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, ছাত্রলীগের ওই কর্মী তো অচল ছিল। তবু তাকে কেন হত্যা করা হলো? সরকার এদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? এসব ঘটনা দেশব্যাপী একটি নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা। বিগত সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ চাপা পড়ে ছিল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে মানুষ সেসব ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে। এর মধ্যেও আবার অনেক দুষ্কৃতকারী সুযোগ নিয়েছে, এখনও নিচ্ছে। তবে সে যা-ই হোক, আইনের বাইরে কোনো কিছু ঘটতে দেওয়া ঠিক হবে না। কারও অপরাধ থাকলে মব ট্রায়াল নয়, তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইনজীবী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি মব ট্রায়ালের এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত ও দমন করতে না পারে, তাহলে ছাত্র অভ্যুত্থান হোক আর রাষ্ট্র সংস্কার-তারা যেভাবেই বলুক, সেটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। জনগণের যে আশা-উদ্দীপনা ছিল, সেটি যদি বিপর্যস্ত হয়, তা হবে জাতির জন্য এক বিশাল হতাশার অধ্যায়। বিচারাঙ্গনেও মব ট্রায়াল হয়েছে। আমরা দেখেছি, বিগত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের আদালতে নাজেহাল করা হচ্ছে। শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়েছে।
জেড আই খান পান্না আরও বলেন, আমরা দেখছি, গণহারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। সাংবাদিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। আইনজীবীদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা হচ্ছে। এসব মামলা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে বর্তমানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল হিসাবে এ সরকারকেই দায়ভার বহন করতে হবে। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। কিন্তু হেনস্তার জন্য কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যেন মামলা দেওয়া না হয়।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ নিশ্চিত ছিল যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি বড় অপরাধী। তাকে বিচার ব্যবস্থায় দেওয়া হলে শাস্তি হবে না, কারাগার থেকে বের হয়ে আসতে পারে। সেই আশঙ্ক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (পুলিশ-র্যাব) তখন ক্রসফায়ারে বহু লোককে মেরে ফেলল। তাই আমি মনে করি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন বেআইনি, তেমনি বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেসব সমমানের না হলেও বেআইনি কাজ।
শাহদীন মালিক বলেন, যে দেশের মানুষ যত বেশি বিশ্বাস করে যে, শাস্তি কঠিন হলেই অপরাধ কমবে, সেসব দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বহু বছর ধরে চর্চা করছি, কোনো কিছু হলেই কঠোর শাস্তি চাই। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলে মাত্র সাতটি অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। পাকিস্তান আমলে একটি অপরাধ বাড়ল। আর বাংলাদেশে এখন পঁয়ত্রিশটি (৩৫) অপরাধের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। তার মানে স্পষ্টতই আমরা মনে করছি যে, যত কঠিন শাস্তি হবে, ফাঁসি হবে, তাহলে অপরাধ কমবে। কিন্তু বাস্তবে উলটো। সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, শাস্তি বাড়িয়ে কোনো দেশে অপরাধ কমে নাই। শাস্তি বাড়ালে শাস্তিটাই যখন মোক্ষম হয়ে যাচ্ছে, তখন ওই সব দেশে আস্তে আস্তে মানুষ বিচারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। এইযে গণপিটুনি হচ্ছে এগুলো এসবের প্রতিফলন।