বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা হয়ে দুর্নীতির সনদ হাতে পান পাউবোর রেজাউল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫২ এএম
সারা দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধিগ্রহণকৃত প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভূমি রাজস্ব পরিচালক মো. রেজাউল করিম। এখান থেকে শত শত একর জমি নামে-বেনামে, লিখিত ও মৌখিকভাবে লিজ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। কী পরিমাণ জমি বরাদ্দ বা লিজ দেওয়া হয়েছে, অবশিষ্ট জমির পরিমাণই বা কত-এসবের কোনো হিসাব মিলছে না। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী এবং গোপালগঞ্জের নাম ব্যবহার করে কর্মস্থলে নিজের ক্ষমতার বলয় প্রসারিত করেছেন। এভাবেই ৩৫ হাজার একর জমির অলিখিত মালিক সেজে বসেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবে নিজেকে ক্ষমতাবান বলে জাহির করায় এতদিন কেউ কিছু বলার সাহস পাননি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে তার অপকর্মের খতিয়ান প্রকাশ্যে আসা শুরু করেছে। ৫ বছরে তিনি এ অবৈধ আয়ে শুধু বনানীতেই কিনেছেন বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাট। লাখ লাখ টাকার এফডিআরসহ দামি গাড়ি এবং নিজ গ্রামে দৃষ্টিনন্দন বাড়িও করেছেন। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে এ কর্মকর্তার দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।
জানা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করে পাউবো থেকে একটি দপ্তরাদেশ জারি করে দুর্নীতির লাইসেন্স নিজের কবজায় নেন এই রেজাউল।
রেজাউল করিম পাউবোর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব নিয়ে যেন দুর্নীতি করার সনদ হাতে পান। পাউবোর সিনিয়র কয়েকজনকে ডিঙ্গিয়ে উপপরিচালক থেকে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ভূমি ও রাজস্ব পরিচালক পদে পদোন্নতি আদায় করেন। এরপর তার লাগাম টেনে ধরা যায়নি। পরে ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি পাউবোর ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তর থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জের ক্ষমতায় দুই মাসের মাথায় ২০২০ সালের ১৯ মার্চ আবারও তিনি ভূমি-রাজস্ব পরিদপ্তরে পোস্টিং নিয়ে ফিরে আসেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর অবৈধ হস্তক্ষেপে পাউবোতে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হন। এ কর্মকর্তা ঢাকা সিটিসহ সারা দেশে আওয়ামীপন্থি ‘নীল দল’-এর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাউবোর অধিগ্রহণকৃত ৩৫ হাজার একরের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার একর জমি নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে লিখিত ও মৌখিক লিজ দিয়েছেন। ঘুস, দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন এ কর্মকর্তা।
রেজাউল করিম বাসা ভাড়া ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাদ দিয়ে প্রতিমাসে বেতন পান ৫৮ হাজার টাকা। অথচ ২০১৯ সালে ভূমি ও রাজস্ব পরিদপ্তরে যোগদানের পর তার সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। শুধু বনানীতেই তিনি আলিশান দুটি ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছেন। ফ্ল্যাট ২টির বাজারমূল্য অন্তত ৮ কোটি টাকা। বনানী আই ব্লকে ১নং রোডে ২১নং প্লটে আধুনিক ডিজাইনে নির্মিত ভবনে তার বি-৩নং ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ৫৯০৮নং দলিলে ২৭১৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক রেজাউল করিম। স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের নামে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বনানীর কে-ব্লকে। ২০২১ সালে ১০ অক্টোবর ১৫৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রি হয় গ্যারেজসহ। ফ্ল্যাটের ঠিকানা: ব্লক-কে, রোড-২০, প্লট-৩০, ফ্লাট-বি/৪। গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল নং ৬৮১২। এছাড়াও ঢাকার উত্তরায় রয়েছে ২৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। ঠিকানা: বাড়ি নং-২১, রোড নং-০২, সেক্টর-১৩, উত্তরা মডেল টাউন। মিরপুরে ১টি ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, উত্তরায় ৫ কাঠার প্লট এবং কক্সবাজারে স্যুট ক্রয় করেন। জামালপুর সদরের বেলটিয়ায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের একাধিক গাড়ি আছে তার। এর মধ্যে যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে ঢাকায় এলিয়ন গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও ফাইন্যান্স কোম্পানি আইপিডিসি, জাতীয় সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার নামে, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার এফডিআর, সঞ্চয়পত্র।