ড. ইউনূস সরকারের এক মাস
স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নতুন বাংলাদেশ
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৯ এএম
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গত ৮ আগস্ট শপথ নেন ড. ইউনূস
ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত বিপ্লব আর হাজারও ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনমুক্ত হয় দেশ। ৫ আগস্ট নতুন এক বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে বিশ্বে। স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের তিন দিনের মাথায় ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। নানামুখী চ্যালেঞ্জ, শঙ্কা-ষড়যন্ত্রের চাপ সামলে এক মাস পার করেছে নতুন সরকার। সরকার পতনের পর সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নতুন বাংলাদেশ। ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছে সরকারের প্রথম মাসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলা কাটতে শুরু করেছে। সচল হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বৈদেশিক সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ব নেতাদের স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতার আশ্বাসে আস্থা ফিরছে জনমনে। এক মাস কোনো মূল্যায়নের সময় নয়। তবে এ পর্যন্ত নেয়া সরকারের উদ্যোগ সন্তোষজনক। সামনে আরও কাজ করতে হবে। সামনের এক থেকে দুই মাসের মধ্যে মানুষের আস্থা ফেরানোর মতো আরও উদ্যোগ দৃশ্যমান করতে হবে।
গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল উপায়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় জনস্বার্থকে। আজ ৮ আগস্ট, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো। এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ দেশের ১২টি জেলায় বয়ে যাওয়া বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন তিনি এবং তার সরকার। তিনি বলেছেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই ভারতের সঙ্গে কথা বলবেন। এ মাসেই তিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও যোগ দিচ্ছেন।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন ১৯৮ জন বিশ্বনেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ ৯২ জন নোবেলজয়ী। ইতোমধ্যেই জাতির সামনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনার রোডম্যাপ দিয়েছেন। বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে। বৈঠকে তিনি আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। পরে এই সরকারে যোগ দেন আরও চার উপদেষ্টা। সব মিলিয়ে ২১ সদস্যের এই সরকারের পথচলার আজ এক মাস পূর্তি হলো।
অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া সরকারকে শুরুতেই যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হচ্ছে বিগত সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ নিরসনের কাজে। যদিও কাজটি এত সহজ নয়, তারপরও গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান বৈষম্য ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অনেক পরিকল্পনাই করছে ড. ইউনূসের সরকার। পুলিশকে কাজে ফিরিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অচল থানাগুলোকে কাজের উপযোগী করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। সচিবালয়কে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তথাকথিত আনসার বিদ্রোহ দমন করে তাদের ব্যারাকে ফেরত পাঠিয়েছে সরকার।
পাশাপাশি সামনে চলার জন্য তার নিজের ঘর গোছানোর কাজও করতে হয়েছে মাসজুড়ে। এই কাজটিও শেষ হয়নি। তারপরও আগামীর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সচিবদের সৃষ্টিশীল ও নাগরিকবান্ধব মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচির কর্মপরিকল্পনা দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যা নিয়মিত মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। নতুন বাংলাদেশ গড়তে পুরোনো চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল উপায়ে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সচিবদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেভাবেই চলছে কাজ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রথম এক মাসে সরকারের নেওয়া অনেক পদক্ষেপই ইতিবাচক। এই এক মাসের মধ্যেই নতুন সরকার প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদলের কাজে হাত দিয়েছেন, যা এখনো চলমান। আর্থিক খাতের সংস্কারের অংশ হিসাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। এটা সুশাসনের ইঙ্গিত বহন করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজে গতি ফেরাতে ড. আহসান এইচ মনসুরের মতো ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে হাত দিয়েছেন, যেগুলো আগে অসৎ ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল। বিগত সরকারের আমলে আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারি উদঘাটন ও শ্বেতপত্র প্রকাশের লক্ষ্যে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া কিছু সৎ ও সাহসী মানুষ এই সরকারে যোগ দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক ফল আশা করছে সাধারণ মানুষ।
এই সরকারের প্রথম মাসেই হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ আমলের মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়েছে, হচ্ছে। ইতোমধ্যেই শতাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যেগুলোর বেশির ভাগই হত্যা মামলা। একইভাবে আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগ সভাপতির পরিবার ও নিকট আত্মীয় এবং মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক নেতাকর্মীকে। তাদের কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন। এর বিপরীতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একাধিক মামলার সাজা বাতিল করা হয়েছে। মুক্তি দেওয়া হয়েছে কারাগারে বন্দি বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। সেই সঙ্গে জামিন দেওয়া হয়েছে জঙ্গি কার্যক্রমসহ গুরুতর মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের, যা নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে। পুলিশ কাজে ফিরলেও পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ছেন, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্তসহ নানান চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। যে প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হয়ে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাস দেওয়া সিদ্ধান্ত হয়েছে। বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে নতুনদের। প্রশাসনকে নতুন করে সাজাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তন করে নতুনদের পদায়ন করা হয়েছে। যাদের পদায়ন করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই চুক্তিভিত্তিক। তবে প্রথম এক মাসেই বদলি করা ২৫ জেলার ডিসি পদে এখনো কাউকে নিয়োগ দিতে পারেনি অন্তর্র্বর্তী সরকার। গত সরকারের গঠিত পুরো নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করলেও এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দুদকের বিষয়ে কোনো কথাও বলেনি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।