বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ
ব্যাংক কর্মকর্তার লুটপাটে সহযোগিতা-ব্ল্যাকমেইলিং
কায়েস আহমেদ সেলিম
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১০ পিএম
এবি ব্যাংকের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মহররম হোসেন। ছবি-সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কিছু কর্মকর্তাকে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে ব্যাংক খাতের অনেককে ব্ল্যাকমেইলিং করেছেন। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে অর্থ আÍসাত ও পাচারে সহযোগিতা করেছেন বিতর্কিত ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন অভিযোগ জমা পড়েছে এবি ব্যাংকের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মহররম হোসেনের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহররম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। তিনি যে কয়টি ব্যাংকে চাকরি করেছেন সবটিতেই তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বেনামে ঋণ প্রদান, অর্থ পাচারে সহায়তা থেকে শুরু করে নারী কর্মকর্তাদের হয়রানির মতো অপরাধের তথ্য উঠে এসেছে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ তদন্তে ও নারী সহকর্মীদের দাখিলকৃত অভিযোগে।
একসময় হাতিরপুল শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ মহররম। ওই সময় বেনামে ঋণ প্রদান ও অর্থ পাচারে সহায়তাসহ বেশকিছু অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ তদন্তে। এতে বলা হয়েছে, কুয়েতে কারাদণ্ড ভোগকারী সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেছেন মহররম। তার শাখায় পাপুল এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৬৪৭টি অ্যাকাউন্ট খুলে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুযোগ দেন তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে সাতটি কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছেন শাখা ব্যবস্থাপক মহররম। এমনকি, অনেককে ভুয়া ব্যবসায়ী সাজিয়ে ঋণ দিয়ে নিজে সুবিধা ভোগ করেছেন। এমনকি বন্ধুর কোম্পানির কর্মচারীকে ব্যবসায়ী সাজিয়েও ঋণ দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে ব্যাংকটির তদন্ত দল। এছাড়া, ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে এলসি খোলারও সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এফআইসিএসডি’র পরিচালকের কাছে জাকির হোসেন নামে এক ব্যক্তির দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, বিগত ১৫ বছরে যারা ব্যাংক খাতে লুটপাট চালিয়েছে তাদের সঙ্গে সৈয়দ মহররমের ঘনিষ্ঠ সখ্য ছিল। এদের মধ্যে ছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী শহিদুল আহসান, পি কে হালদারের সহযোগী শাহিদ রেজা, কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল, সালমান এফ রহমানসহ অনেকে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, মহররমের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা। অনেক নারী সহকর্মীও তার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মহররমের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছেন না।
এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে অনুসন্ধানে। এক নারী কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে মহররমের বিরুদ্ধে। মহররম ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্য গভীর কৌশল ব্যবহার করেন। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে বেনামী অভিযোগ লিখে জমা দেন দুদকে ও বাংলাদেশ ব্যাংকে। নিজস্ব সিন্ডিকেটের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করান তিনি। এরপর নিজেই হয়রানির শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাছে যান তাদেরকে হয়রানি থেকে বাঁচানোর প্রস্তাব নিয়ে। ভুক্তভোগীকে হয়রানি থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব নেন মহররম। এর বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ নেন। এভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন মহররম।
মহররমের আয়েশি জীবনযাপন আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পাওয়া যায়নি। ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। ঘরের আসবাবপত্র অধিকাংশই চীন থেকে আমদানি করা। ধানমন্ডি ও পূর্বাচলে জমি রয়েছে। দুটি দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে নিজ গ্রামে আড়াই কোটি টাকা খরচ করে ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছেন। বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরেন যেগুলোর মূল্য আড়াই থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত। ব্লেজার, জুতা, জামাকাপড় কেনেন ভারতের দামি ব্র্যান্ডগুলো থেকে।
সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূতভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে সৈয়দ মহররম হোসেনের। বাংলাদেশি পাসপোর্টের পাশাপাশি ভারতীয় পাসপোর্টও রয়েছে তার-এমন তথ্যও এসেছে ওই অভিযোগে।
জানা গেছে, মহররম হোসেনের চাকরি জীবন শুরু ২০০২ সালে, রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসাবে। কিছু দিন পর সরকারি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন ঢাকা ব্যাংকে। ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন লোন রিকভারি বিভাগের। এ সময় থেকেই শুরু করেন ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতানোর কাজ।
ঢাকা ব্যাংক থেকে চাকরি ছেড়ে যোগ দেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে। সেখানে সখ্য গড়ে তোলেন শহিদুল আহসানের সঙ্গে, যিনি ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের কারণে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক পদ হারিয়েছেন। অভিযোগ থেকে জানা যায়, মহররম হোসেনের পরামর্শে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে বেনামে শেয়ার কিনেছিলেন শহিদুল। এই শেয়ারের মাধ্যমে দুজনকে ব্যাংকটির পর্ষদের পরিচালক বানান তিনি। শহিদুলের স্বার্থ দেখার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছেড়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত এনআরবিসি ব্যাংকে যোগ দেন মহররম। এদিকে নিজে পরিচালক না হয়েও পরিচালনা পর্ষদের সভায় নিয়মিত যোগ দিতে থাকেন শহিদুল আহসান। ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে হাতিয়ে নেন প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শহিদুলের সব স্বার্থ দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন মহররম।
শহিদুলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে মহররম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন ব্যাংকটির আরেক পরিচালক কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সঙ্গে। ব্যাংক কর্মকর্তা হয়েও পাপুলের ব্যবসা এমনকি সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করেন মহররম। এনআরবিসি ব্যাংকের হাতিরপুল শাখা ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনকালে পাপুলের ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সৈয়দ মহররম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা।