বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী, কবে হবে নির্বাচন?
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০১:৪৯ পিএম
প্রতীকী ছবি
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কার্যত অনুপস্থিত৷ সেই শূন্য অংশ পূরণে এখন দেশটিতে নানান রাজনৈতিক গোষ্ঠী তৎপর। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এর পর শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ তাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অনেকেই আটক হয়েছেন৷ এ অবস্থায় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের শেখ হাসিনা ছেড়ে চলে যাওয়ায় দলটির অনেকেই অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন৷
তবে দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকা আওয়ামী লীগের এখনকার নিষ্ক্রিয়তায় রাজনীতির অঙ্গনে জায়গা ফাঁকা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, কারা এই সুযোগের সবচেয়ে সদ্ব্যবহার করবে?
দ্রুত আলোচনা চাই বিএনপ
বিএনপির পার্টি অফিসগুলো এখন বেশ তৎপর৷ রাজধানী ঢাকার পল্টন এলাকায় তাদের কার্যালয়ে বৃহস্পতিবারও বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করছিলেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। তাদের অনেকেই নির্বাচন হলেই সরকার গঠন করার ব্যাপারে নিশ্চিত৷
পুলিশে কী কী সংস্কার হবে?
বিএনপি নেতারা একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যৌক্তিক' সময় দিতে প্রস্তুত, একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি রাষ্ট্রসংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করার ব্যাপারে দ্রুতই আলোচনা চান তারা৷
তাদের ভেতর এই তাড়াহুড়ো কেন জানতে চাইলে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ডয়চে ভেলেকে বলেন, যখন রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হয়, তখন সেই শূন্যস্থান পূরণে ঝড় নেমে আসে৷
তিনি বলেন, কৃ্ত্রিমভাবে যদি কোনো শূন্যতাকে দীর্ঘায়িত করা হয়, তাহলে কোনো না কোনো দিক থেকে ঝড়ের মতো তা পূরণ করার চেষ্টা হয়৷ সেজন্য সবচেয়ে ভালো হলো আলাপ আলোচনা করা৷
এদিকে, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যদিও তাদের নেতৃবৃন্দ তা অস্বীকার করে বলেছেন, বিএনপি এখন রাজনীতি করছে৷
বিগত সরকারের আমলে তাদের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হয়েছে অভিযোগ করে দলের ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব মামলা আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান করে তাদের মামলা থেকে মুক্তির চেষ্টা চলছে বলে জানান তারা।
এর আগে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই সরকারকে কতটা সময় দেওয়া যেতে পারে - এমন এক প্রশ্নের জবাবে ‘যৌক্তিক' সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বলেন৷ তিনি বলেন, তারা তো মাত্র দায়িত্ব নিলেন। এখন নিজেরাই সেট না। বসবেন, জানবেন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হলে কাকে কাকে কোথায় বসাতে হবে। আমাদের সে আস্থা আছে৷
তবে সেজন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য সময় দেওয়ারও পক্ষপাতী নন তিনি৷ রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিষয়গুলোতে বিশেষ করে যেগুলোতে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই করতে হবে বলে জানান তিনি৷
তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন কোনো অনির্বাচিত সরকারের অধীন করা সমীচীন নয়৷ আমাদের ৩১ দফায় আমরা অনেক আগে থেকেই সংবিধান সংশোধনের কথা বলে আসছি৷ কিন্তু সেটা করতে হবে জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে৷ সেজন্য একটি নির্বাচিত সংসদ বা গণপরিষদের মাধ্যমে তা করতে হবে৷
তিনি যোগ করেন, যদি কেউ মনে করেন রাষ্ট্র সংস্কার মানে গুটিকতক লোক রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলবেন, সেটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে তো।
জামায়াতের লক্ষ্য ‘ইসলামী জোট নয়, রাজনৈতিক ঐক্য’
বিএনপি আলোচনায় তাগাদা দিলেও তাদের দীর্ঘসময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামী এক্ষেত্রে ভিন্ন পন্থা নিয়েছে। তারা এই সরকারকে যথেষ্ট সময় দিতে চায়।
জামায়াতকে অবশ্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা এবং সমাজসেবায় বেশ তৎপর দেখা গেছে৷
দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে যাওয়া, তাদের সেবা সুশ্রুষায় সহযোগিতা করা ছাড়াও বন্যার্তদের সেবায় কাজ করেছেন৷
রাজনৈতিকভাবেও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চাইছে দলটি৷ স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, ইসলামি দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে তারা। বলা হচ্ছে, দলটি চাইছে যেসব এলাকায় যেসব ইসলামি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ভালো, সেসব এলাকায় ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে আসা। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে কয়েকটি ইসলামি দলের নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের আমিরের বৈঠক হয়েছে।
তবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ ইসলামী জোট করা হচ্ছে বা চেষ্টা হচ্ছে এমন কোনো বক্তব্য জামায়াতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, আমরা ইসলামী জোট তৈরির কথা বলিনি৷ আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দল, শক্তি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে দেশ গড়ার জন্য৷
এদিকে, গত বুধবার জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
শিক্ষার্থীরা চান ‘নন-বাইনারি’ ব্যবস্থা
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কঠিন প্রতিরোধে টিকতে পারেনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার৷ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সম্প্রতি দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডয়চে ভেলেকে বলেন, তারা দেশে ‘বাইনারি পলিটিক্স'-এর বাইরে বেরুতে চান৷
শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল গড়া নিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷
এদিকে, শিক্ষার্থীরা একটি রাজনৈতিক দল করতে পারেন, এই খবর বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনায়৷ সে বিষয়টি বড় রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে দেখছে?
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ছাত্ররা যদি রাজনৈতিক দল করতে চায়, এটা তাদের অধিকার৷ আমরা স্বাগত জানাই৷ গণতন্ত্র তো মাল্টি পার্টি সিস্টেম৷ এখানে শত ফুল ফুটতে দিতে হবে৷
একই কথা বলেন ‘কিংমেকার' পার্টি খ্যাত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও৷ তিনি বলেন, ছাত্ররা দল করলে আমরা সাধুবাদ জানাই৷
তবে এই দল তাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে কিনা সে ব্যাপারে মির্জা ফখরুল বলেন, দেখুন, আমরা আজকের দল করি না৷ আমাদের জন্ম ৭৯ সালে৷ নির্বাচন দিলে বোঝা যাবে কার সমর্থন কতটুকু৷ আমরা রাস্তায়ও প্রমাণ করেছি৷ সুতরাং ওটা নিয়ে আমি কোনো তর্কে যেতে চাই না৷
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে শিক্ষার্থীদের দুই সমন্বয়ক রয়েছেন বলে উল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, তবে সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গড়লে তা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না৷
কবে হবে নির্বাচনের রোডম্যাপ
সম্প্রতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ সেখানে তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের কয়েকটি দিক নির্দেশনা উল্লেখ করলেও নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে পরিষ্কার কোনো পরিকল্পনা তুলে ধরেননি৷ তিনি সবাইকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানান৷
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার প্রশাসনকে চরম দলীয়করণ করার ফলে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছি। তবে প্রশাসনকে গতিশীল রাখতে এবং একইসঙ্গে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সময় প্রয়োজন। সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন জনগণের আস্থা ফিরে পায় সেটি আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য সামিনা লুৎফা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটু পরিষ্কার করে বলা উচিত আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে জুলাই হত্যাকাণ্ডে নিহত ও আহতদের একটি তথ্যভাণ্ডার করা, বিচারের বিষয়গুলোতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেগুলো বলা৷
স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতিকে কেমন করে সামাল দেয়া হবে, এগুলো পরিষ্কার করে বলে এরপর দীর্ঘমেয়াদী বিষয়গুলো তুলে ধরা উচিত বলে মনে করেন সামিনা লুৎফা৷
তার মতে, এই বিষয়গুলো যদি বর্তমান সরকার পরিষ্কারভাবে জানান তাহলে সবগুলো রাজনৈতিক দল আস্থা পাবে এবং মূল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বাইরেও যেসব রাজনৈতিক দল প্রতিক্রিয়াশীল নয় তারাও সময় ও সুযোগ পাবে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার৷
সূত্র: ডয়চে ভেল