অ্যাডিশনাল ডিআইজি এমএ মাসুদ
পদোন্নতির সঙ্গে বদলে যায় স্থাপনার নামফলকও
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০৮:০৮ পিএম
চাকরি জীবনে এখন পর্যন্ত সাকুল্যে বেতন পেয়েছেন দেড় কোটি টাকা। অথচ সরকারি হিসাবেই কৃষি জমি ও প্লট কিনেছেন ২০ কোটি টাকার। এর মধ্যে দুটি প্লটে তৈরি করেছেন বহুতল ভবন। এতে তার খরচ হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকা।
নিজেরা না থাকলেও মানিকগঞ্জ শহরের বাড়িটিও নজরকাড়া। গৃহিণী স্ত্রী, শিক্ষার্থী ছেলেমেয়ের নামেও কিনেছেন একাধিক প্লট। সব মিলিয়ে তার সম্পত্তির বাজার মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। নির্ধারিত বেতনে সরকারি চাকরি করে অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া ‘ভাগ্যবান’ এই ব্যক্তি হলেন পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি এমএ মাসুদ।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জায়গা-জমি ও প্লটের নেশায় বুঁদ মাসুদ ও তার পরিবার।
অভিযোগ আছে-বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য আড়ালে রাখতে প্রভাব খাটিয়ে অনুসন্ধান কাজের গতি থামিয়ে রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে তিনি শিল্প পুলিশে কর্মরত। দুদক থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সরেজমিন জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় সম্পদ গড়ে তুলেছেন এমএ মাসুদ। যেসব এলাকায় তার সম্পত্তি আছে, সেসব এলাকার মানুষ তাকে এসপি মাসুদ হিসাবেই চেনেন। প্রায় প্রতিটি সম্পত্তিতে তার স্ত্রী-সন্তানের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ডের নিচে লেখা আছে-‘প্রযত্নে এমএ মাসুদ, পুলিশ সুপার’। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে তার পদোন্নতির সঙ্গে কিছু স্থাপনার নামফলকও বদলে ফেলা হয়েছে।
মানিকগঞ্জ শহরের ১২/১ বেউথা রোডে অবস্থিত তার নজরকাড়া বাড়ির নামফলকে এক সময় শ্বেতপাথরে খোদাই করা ছিল-‘শরীফ ম্যানশন, এমএ মাসুদ, সহকারী পুলিশ সুপার। অর্থাৎ নাম ফলকের তথ্যই স্পষ্ট করছে, সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে চাকরিতে যোগদানের পরই বাড়িটি করেছেন। তবে অ্যাডিশনাল ডিআইজি হিসাবে পদোন্নতি পাওয়ার পর শ্বেতপাথরের নামফলক থেকে সহকারী শব্দটি ঘঁষে তুলে ফেলা হয়েছে। আর উপরে অ্যাডিশনাল ডিআইজি পরিচয়ে লাগানো হয়েছে নতুন করে নামফলক।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, বাড়িটির প্রধান ফটকটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। ভেতরে গাছগাছালিতে ভরা কয়েক বিঘার ফাঁকা জায়গা। তারই মধ্যে পাকা ভবন। কয়েকবার ফটকের কড়া নাড়লে একজন মহিলা ফটকের ওপারে আসেন। সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি ভেতরে গিয়ে আর ফেরেননি।
স্থানীয়রা জানান, বাড়িতে তার মা ও এক ভাই পরিবার নিয়ে থাকেন। আগে একটি টিনশেড ঘর ছিল। তার (মাসুদ) বাবা পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি করতেন। বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জ সদরের নবগ্রাম ইউনিয়নের দিঘলিয়া গ্রামে। বাবা অবসরে যাওয়ার আগে বেউথায় ওই জমি কিনে একটি টিনশেড ঘর বানিয়েছিলেন।
২১তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০০৩ সালে সহকারী পুলিশ সুপার পদে চাকরি পাওয়ার পর ওই জমির সঙ্গে আরও কিছু জমি কিনে সীমানা প্রাচীর দেন। বাড়িটির চেহারাও ধীরে ধীরে পালটাতে থাকে। টিনশেড থেকে দালানে পরিণত হয়। বাড়িতে এখন তেমন যাতায়াত নেই এই পুলিশ কর্তার। তবে গ্রামের বাড়িতে কিছু কৃষি জমি কিনেছেন।
একটি জমির পাশে গাছে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা, পৈতৃক সূত্রে এই জমির মালিক অতিরিক্ত ডিআইজি এমএ মাসুদ। তার ভাই এমএ শরীফ। মানিকগঞ্জ শহরের চাঁদনী শপিংমলে একটি পোশাকের দোকান আছে তার। শরীফ জানান, ভাইয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। কোথায় তার কর্মস্থল তাও জানেন না তিনি।
জানা গেছে, সম্প্রতি একের পর এক পুলিশ ও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি সামনে এলে এমএ মাসুদ তার ও স্ত্রী-সন্তানের নামে টানানো জমির মালিকানার কয়েকটি সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলেছেন। তবে ঢাকা, সাভার ও ধামরাইয়ের চারটি প্লটে লাগানো শ্বেতপাথরের নামফলক এখনো বিদ্যমান। ধামরাইয়ের ইসলামপুর মাদ্রাসা রোডের বহুতল আবাসিক ভবনের নামফলকটি তুলে ফেলা হয়েছে।
অবৈধ সম্পদ ও দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডিশনাল ডিআইজি এমএ মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। দুদক থেকে আমাকে বিছু জানানো হয়নি।’
দুদক থেকে প্রাপ্ত নথির সূত্র ধরে যুগান্তরের অনুসন্ধানে আপনার স্ত্রী-সন্তানের নামে বহু প্লট ও বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে, এ বিষয়ে কি বলবেন-‘এ নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে কোনো কথা বলব না।’