বেতন বন্ধে মানবেতর জীবনযাপন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
মন্ত্রণালয়-বিজেএমসি চেয়ারম্যানের কারণে ধ্বংস জুট মিলস শিল্প
রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০৩:২৭ পিএম
ফাইল ছবি
চার বছরের অধিক সময় বন্ধ বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন সব জুট মিল। আর্থিক ক্ষতি ও শ্রমিক অসন্তোষ দেখিয়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিজেএমসির ২৫টি মিলের উৎপাদন কার্যক্রম একযোগে বন্ধ করে সরকার। তবে আর্থিক উৎস না থাকায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না বিজেএমসি। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভুক্তভোগীরা। প্রতিষ্ঠানের এমন অবস্থার জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্তারা দায়ী বলে দাবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভুল পরিকল্পনায় ধ্বংস হয়েছে দেশের জুট মিলস শিল্প। এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হস্তক্ষেপ ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করেছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ১৫ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতি আমরা তিন দিনে শেষ করতে পারব না। তবে বিষয়গুলো নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। কেউ দুর্নীতি করবে, আমরা বসে থাকব তা হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, নিজেদের সমস্যা নিয়ে তারা এসেছিল। সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সমস্যাগুলো সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করি তাদের বেতন-ভাতার সমস্যা অল্প সময়ের মধ্যেই সমাধান হবে।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালে ৭৮টি মিল নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই সময় বিজেএমসির জন্য লক্ষ্য ছিল উন্নতমানের পাটজাত পণ্য উৎপাদন, পাটজাত পণ্যের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে নিয়ন্ত্রণ, শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষকদের পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। ১৯৮১ সালে বিজেএমসি নিয়ন্ত্রিত দেশে জুট মিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮২টি। তবে ১৯৮২ সালের পর এগুলোর মধ্যে ৩৫টি বিরাষ্ট্রীয়করণ, আটটি জুট মিলের পুঁজি প্রত্যাহার এবং একটি জুট মিল (বনানী) ময়মনসিংহ জুট মিলের সঙ্গে একীভূত করায় বিজেএমসি নিয়ন্ত্রিত মিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮টিতে। নানা কারণে বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫টিতে। তবে সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাইয়ে আর্থিক ক্ষতি ও শ্রমিক অসন্তোষ দেখিয়ে বিজেএমসির ২৫টি মিলের উৎপাদন একযোগে বন্ধ করে সরকার। বিজেএমসি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, একসময় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন সরাসরি প্রান্তিক কৃষকের নিকট হতে ন্যায্যমূল্যে কাঁচাপাট সংগ্রহ করত। বিজেএমসি’র উৎপাদিত পাটজাত পণ্য বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে রপ্তানি হতো। তা থেকে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো। পাটজাত পণ্য দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখত। এছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে সরকারি প্রতিষ্ঠান, খাদ্য অধিদপ্তর, বিএডিসি ও বিসিআইসির চাহিদা মোতাবেক পাটজাত পণ্য সরবরাহসহ বাজারে বিক্রি করে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা আয় করত।
তাদের দাবি, দেশের জুট মিল বন্ধের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তি কাজ করেছে। কোনো নির্দিষ্ট দেশকে বিশেষ সুবিধা দিতে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের পাটশিল্প ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়াও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব, অব্যবস্থাপনা, সময়মতো কাঁচামাল কিনতে না পারা, উৎপাদনের কাজে অদক্ষ শ্রমিকের ব্যবহার, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে পাট ক্রয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়েছে দেশীয় পাটজাত পণ্য। এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরং দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা না করে প্রতিবেশী দেশকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব মিল কেন বন্ধ হয়েছে তারও কারণ অনুসন্ধান করা হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালে মিলের উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর প্রায় তিন বছর ধরে মিলের অবশিষ্ট প্রসেস মালামাল, স্টোরে রক্ষিত মালামাল ও স্ক্যাপ বিক্রির অর্থ দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হতো। একই সঙ্গে ওই অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচলনা ব্যয় বহন করা হতো। তবে আর আর্থিক উৎস না থাকায় সর্বশেষ তিন মাস ধরে বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না।
অভিযোগ রয়েছে, মিলের অবশিষ্ট প্রসেস ও স্টোরে রক্ষিত মালামাল এবং স্ক্যাপ বিক্রির বড় অংশ লোপাট হয়েছে। এসব অনিয়মের সাথে যুক্ত ছিলেন সাবেক মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির শীর্ষ ব্যক্তিরা। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিজেএমসির মিলগুলোর স্ক্র্যাপ মালামাল ৪৭ কোটি সাত লাখ ৯০ হাজার টাকা বিক্রির অনুমোদন দেন বিজেএমসি’র পর্ষদ।
বিজেএমসির কর্মচারীরা বলছেন, সব মিল বন্ধ হওয়ায় একযোগে চাকরিচ্যুত হয়েছে ৭৫ হাজার শ্রমিক। আর আইনে সুযোগ না থাকায় মিলগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে বেতন বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। একই সাথে দীর্ঘদিন ধরে প্রাপ্য সরকারি সুবিধায় উচ্চতর গ্রেড, সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল, পদোন্নতি, বিনোদন ছুটি, চাকরির নিশ্চয়তাসহ নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব ফারুক আহম্মেদ যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়েছে এমন একপেশে কথা বললে হবে না। বেশ কিছু সমস্যার কারণেই সরকার মিলগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বিষয়ে তিনি বলেন, তিন মাসের বেতন বন্ধ রয়েছে। কেন বেতন বন্ধ হয়েছে সেই ইতিহাস আমার জানা নেই। কারণ আমি এখানে নতুন এসেছি।
নিজেদের এসব দাবি নিয়ে সোমবার বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবের আশ্বাসের পর নিজেদের মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করেন তারা। তবে বেতন-ভাতা ও চাকরির নিশ্চয়তা না পেলে আন্দোলনের পথেই এগুবেন তারা।
বন্ধ সব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ও চিনিকল খুলে দেওয়া, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল ও বকেয়া পাওনা পরিশোধ দাবিতে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে কর্মসূচি পালন করে জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ। এতে বক্তারা বলেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ সাম্রাজ্যবাদ ও দেশি পুঁজিপতিদের স্বার্থে সরকারি নীতি, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ফলাফলস্বরূপ এসব প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সমাবেশ শেষে তারা বিজেএমসি কার্যালয় ঘেরাও করেন ও করপোরেশনের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পাট উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন।