পিতা আনোয়ার হোসেন ছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। পিতার পরিচয়ে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন ছিলেন কবির বিন আনোয়ার।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী চাকরি হারানোর ভয়ে কথা বলতে পারতেন না। এভাবে নিজের ইচ্ছামতো প্রকল্প ভাগিয়েছেন সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে। আওয়ামী লীগের তকমা লাগিয়ে যে কজন আমলা থেকে শত শত কোটি টাকা ভাগিয়ে নিয়েছেন তার মধ্যে কবির বিন আনোয়ার অন্যতম।
বিপুল অর্থবিত্ত গড়ে তুলেছেন কবির বিন আনোয়ার। তার দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় ঢাকা, গাজীপুর, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। এসব জায়গায় তিনি ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। গাজীপুরের বাগানবাড়ি, সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজারের বিনোদনকেন্দ্রে ছুটির দিনে নারী নিয়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ও এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক থাকাকালীন তার আত্মীয়স্বজনদের ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন কবির বিন আনোয়ার। তাদের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ২০১২ সাল থেকে সিনিয়র সচিব হিসাবে চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার আগ পর্যন্ত সব প্রকল্প তদন্ত করলে শত শত কোটি টাকা লোপাটের তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা মানিক চৌধুরী। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ দাখিল করেন।
সেই অভিযোগটি আমলে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। অভিযোগে তিনি সিরাজগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিগত কয়েক বছরের বরাদ্দ তদন্তের আওতায় নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। বরাদ্দের মধ্যে অন্তত আড়াইশ কোটি টাকার কাজ অবৈধভাবে তার আত্মীয়স্বজন ও অনুসারীদের দিয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হয়।
সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার সয়াগোবিন্দ পাড়ার সুলতান মাহমুদকে ৭০ কোটি টাকা, হোসেনপুরপাড়ার জাকির হোসেনকে ৬০ কোটি টাকা, দিয়ারধানগড়ার নাছিমুর রহমানকে ৪০ কোটি টাকা, হোসেনপুরপাড়ার জাকির হোসেনকে ২৫ কোটি টাকা, স্টেডিয়াম রোডের রাশেদ ইউসুফ জুয়েলকে ১০ কোটি টাকা, রেলওয়ে কলোনি (চামড়াপট্টি) আব্দুল্লাহ বিন আহমেদকে ২০ কোটি টাকার কাজ, দত্তবাড়িপাড়ার হোসেনকে ২০ কোটি টাকার কাজ, সমাধানগড়াপাড়ার শামসুজ্জামান আলোকে ২৫ কোটি টাকার কাজ, জানপুরের বদরুল আলমকে ১২ কোটি টাকা, কামারখন্দ উপজেলার পেছরপাড়া গ্রামের সেলিম রেজাকে ৮০ কোটি টাকার কাজ, ঝাঐলগ্রামের হীরাকে ৩০ কোটি টাকার কাজ, নান্দিনা মধু গ্রামের সানোয়ারকে ১৫ কোটি টাকার কাজ সাবকন্ট্রাক্টে ভাগ করে দিয়ে লুটপাটে ভাগ বসিয়েছেন।
আবার এদের প্রধান করেই মাদকাসক্ত ও সন্ত্রাসীদের নির্মূলে গ্রুপ করে দিয়েছেন। অথচ এরাই এলাকায় বিতর্কিত। তারা নিম্নমানের কাজ করে এবং কিছু কিছু কাজ একেবারেই না করেও প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন। কবির বিন আনোয়ারের বোনজামাই হিলটনের ভাই শামিমুর রহমান শামিমের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়ার দুর্নীতিসহ সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। এ কাজে সহযোগিতা করে কবির বিন আনোয়ারের মাদক পার্টনার হিরন, চাচাতো ভাই তরুন ও আরিফ। তার আত্মীয়স্বজনের সিন্ডিকেট ঠিকাদারিসহ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য ব্যাপারেও ব্যাপক দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ করেন।
তিনি চাপ প্রয়োগ করে অবৈধভাবে প্রকল্প তৈরির সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের দিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেন। নিয়মবহির্ভূতভাবে বিশেষ জরুরি আখ্যা দিয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া না করে সরাসরি বিভিন্ন ঠিকাদারদের কাজ দেন। তাছাড়া প্রকল্প চলাকালেও দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ মাত্রাতিরক্ত অর্থ বরাদ্দ প্রদান করেন। তার আমলে এভাবে শুধু অতিরিক্ত বরাদ্দের মাধ্যমেই ত্রিশ হাজার কোটি টাকা লুট করার অভিযোগ করা হয়েছে।
অন্য দপ্তরের নারীকে বছরের পর বছর নিজের কাছে রাখেন কবির
শুধু সিরাজগঞ্জেই প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় পাঁচ-ছয়গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলাধীন সিংড়াবাড়ী, পাটগ্রাম ও বাঐখোলা এলাকার নদীর তীর সংরক্ষণে প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটারে ১২ কোটি থেকে ১৭ কোটি স্বাভাবিক ব্যয় আকস্মিকভাবে ৭৩ কোটি টাকা করা হয়। তার আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তাদের পুকুর খননে প্রশিক্ষণ নিতেও বিদেশ পাঠানোর নজির রয়েছে। নদী খননের জন্য ড্রেজার ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ১২৯২ কোটি ২৪ লাখ ৩১ হাজার টাকার প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাবেক সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। পানিসম্পদ সচিব পদে যোগদানের পর বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সব কার্যক্রম মূলত কবির বিন আনোয়ারের পরিবারের লোকজনই নিয়ন্ত্রণ করত। কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা করত না তারা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দিক থেকে তার অবস্থান ৪-৫ নম্বরে বলে প্রচার করতেন তিনি। দেশের বাইরেও অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
সোনাদিয়া ও রাজেন্দ্রপুরের বাগানবাড়িতে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনও অবগত। এসব কারণে তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গেও তার সম্পর্কে টানাপোড়েন। তার প্রথম স্ত্রী আত্মীয়তার সম্পর্কে তার খালা। কবির বিন আনোয়ারের সব কটি মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।