বিদেশযাত্রায় সর্বশেষ বিমানবন্দরে গিয়ে ফিরে এলেও ভ্রমণে উদারপন্থি ছিলেন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
তৃতীয় মেয়াদে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে প্রথম কর্মদিবসেই বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেন তিনি। তবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিজেই তা রক্ষা করেননি। বরং বিদেশ ভ্রমণে এতটাই উদার ছিলেন, নিজের একান্ত সচিব এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকেও (পিও) বিদেশ সফর করিয়েছেন তিনি।
পলকের এমন নজিরে পিছিয়ে ছিলেন না আমলারাও। মন্ত্রণালয়, অধীনস্থ দপ্তর, সংস্থা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যে যেভাবে পেরেছেন, করেছেন বিদেশ সফর।
বিদেশ সফরসংক্রান্ত সরকারি আদেশ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে সাত মাসের দায়িত্বকালেই নিজেসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন। দ্বাদশ সংসদে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শুরুর প্রথম কার্যদিবসেই বছরের প্রথম ছয় মাস আইসিটি বিভাগের সব বিদেশ সফর বন্ধ থাকবে বলে নিষেধাজ্ঞা দেন।
এমনকি উল্লেখিত সময়ে তিনি নিজে এবং আইসিটি বিভাগের সচিবও বিদেশ সফর করবেন না বলে ঘোষণা ছিল তার। কিন্তু ঘোষণার সাড়ে তিন মাসেই প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন বিদেশ সফর করেছেন।
গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওস্থ আইসিটি টাওয়ারে অনুষ্ঠিত ওই মতবিনিময় সভায় পলক বলেছিলেন, আমাদের রপ্তানি উপার্জন বাড়াতে হবে, রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ যেটি আমার হাতে আছে, আগামী ছয় মাস (জানুয়ারি-জুন) আমি বিদেশে যাব না, সচিব যাবেন না। আইসিটি বিভাগের কেউ বিদেশ সফরে যাবে না। কোনো প্রশিক্ষণে না, কোনো শিক্ষা সফরে না। আমরা আগামী ছয় মাসের জন্য সম্পূর্ণভাবে বিদেশ সফর বন্ধ করে দিলাম।
তবে মুখে বলা এসব কথার প্রয়োগ বাস্তবে দেখা যায়নি। বিদেশ সফরে এতটাই উদার, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। গত এপ্রিলে তিনি থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেন। এরপর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওরাকলের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন তিনি। তার এ ভ্রমণের খরচ বহন করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) একটি প্রকল্প। এ ছাড়াও গত জুনে ফ্রান্সে যান পলক।
শুধু নিজে ভ্রমণ করেছেন এমনটি নয়। পলকের আশীর্বাদে মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পর্যায়ের আমলারাও বিদেশ সফরের সুযোগ পেয়েছেন। ২৬ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ‘মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস-২০২৪’-এ অংশ নিতে স্পেনের বার্সালোনা সফর করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান এবং যুগ্ম সচিব তৈয়বুর রহমান।
একই অনুষ্ঠানের জন্য ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত স্পেন সফর করেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সদ্য পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ। তার সফরসঙ্গী ছিলেন বিটিআরসির আরও দুই কর্মকর্তা।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত সফরসংক্রান্ত এক আদেশে দেখা যায়, ফ্রান্স সফর করেন বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও সিমিউই ৬ প্রকল্পের পরিচালক মির্জা কামাল আহমেদ। তার সফরসঙ্গী ছিলেন প্রতিমন্ত্রী পলকের ব্যক্তিগত সচিব মুশফিকুর রহমান। তবে সেই আদেশে সফরকালের তারিখ উল্লেখ নেই।
২৯ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেন পোস্টমাস্টার জেনারেল কার্যালয়ের সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল (স্টাফ) নাইমুর রহমান। তিনি সেখানে ‘ব্যবসা উন্নয়ন এবং বিপণন কোর্স’ শীর্ষক একটি ওয়ার্কশপে অংশ নেন। ওই প্রশিক্ষণের খরচ আয়োজক প্রতিষ্ঠান বহন করবেন বলা হলেও ১ জানুয়ারি জারি করা সরকারি আদেশে ‘আয়োজক’ কে বা কারা, সে সম্পর্কে কোনো তথ্যের উল্লেখ ছিল না।
ডাক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাদিয়া আফরিন বৃষ্টির নামে বিদেশে সফরের অনুমতি দিয়ে আদেশ জারি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন উল্লেখ করে ওই আদেশে বলা হয়, তার সফরের ব্যয় বহন করবে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক।
২৬ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি ওয়ার্কশপে অংশ নিতে মালদ্বীপ সফর করেন আইসিটি বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম সচিব এটিএম জিয়াউল ইসলাম।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কর্মকর্তারাও পিছিয়ে নেই বিদেশ সফরে। ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি দুবাই সফর করেন কমিশনের উপপরিচালক (এসএস) এসএম তাইফুর রহমান। বিদেশ সফরসংক্রান্ত সরকারি আদেশ অনুযায়ী, সেখানে ‘আইএসএস ওয়ার্ল্ড (ইন্টেলিজেন্স সাপোর্ট সিস্টেমস ফর ইলেক্ট্রনিক সার্ভেল্যান্স, সোশ্যাল মিডিয়া/ডার্ক ওয়েব অ্যান্ড সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তার এ সফর। এ সফরের খরচ বহন করবে 'স্পাইডার ডিজিটাল ইনোভেশন এফজেড এলএলসি'।
সিঙ্গাপুরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কেন্দ্র সফরের অনুমতি পান বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস (এসএস) বিভাগের চার কর্মকর্তা। জিও অনুযায়ী, ৫ থেকে ৮ মার্চ তারা সেখানে অবস্থান করবেন।
এ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন - পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম রেজাউর রহমান, জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক তৌসিফ শাহরিয়ার, উপসহকারী পরিচালক কামাল সিদ্দিকী এবং মাসুম খান।
থাইল্যান্ডের পাতায়াতে ‘এপিটি ওয়্যারলেস গ্রুপ’-এর ৩২তম সভায় অংশ নিতে অনুমতি পায় কমিশনের আরেক উপপরিচালক (এসএম) মাহফুজুল আলম। ৪ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত এ সফরের খরচ বহন করবে এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি।
এছাড়া আইকান কমিউনিটি ফোরামে অংশ নিতে ২ থেকে ৭ মার্চ পুয়ের্টো রিকোতে যান বিটিআরসির উপপরিচালক ড. শামছুজ্জোহা।
প্রতিমন্ত্রীর বিদেশ সফরের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে বিদেশ সফর করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মকর্তারাও। ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ইনফরমেটিক্স পরিদর্শনে যান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসির) নির্বাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার এবং পরিচালক (ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) গোলাম সারওয়ার।
২০ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাইল্যান্ড সফর করেন বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ‘বিডিসেট’ প্রকল্পের পরিচালক আমিরুল ইসলাম। এ সফরের খরচ বহন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এজেড টেকনোলজি’।
১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ মার্চ থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেন বিটিসিলের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) নওরিন তানিয়া, ব্যবস্থাপক (কারিগরি) মেসবাহ সালাউদ্দিন সজিব, ব্যবস্থাপক (কারিগরি) আবদুল্লাহ আল মামুন, ব্যবস্থাপক (কারিগরি) শামীম ফকির, সহকারী প্রকল্প পরিচালক আসিফ আহামেদ এবং ব্যবস্থাপক (কারিগরি) জামরুল ইসলাম।
১৯ থেকে ২৫ মার্চ চীন ভ্রমণ করেন পলকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সুব্রত কুমার সরকার, টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক সালেহ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব আলাওল কবির, টেলিটকের সিনিয়র ম্যানেজার সঞ্জয় কুমার সরকার।
১৮ থেকে ২২ মার্চ থাইল্যান্ড ভ্রমণের অনুমতি পান ডাক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পোস্ট সেবা) এসএম শাহাব উদ্দিন এবং সেকশন অফিসার হাসানুজ্জামান।
এ ছাড়াও ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ মার্চ চীন যান বিটিসিলের ডিজিএম মোহাম্মদ মাসুদ রানা, ডিজিএম রওনক তাহমিনা, ব্যবস্থাপক (কারিগরি) জয়িতা সেন রিমপি, ব্যবস্থাপক (কারিগরি) মিহির রয় এবং নিশা আবদুল্লাহ।
সফরসংক্রান্ত সরকারি আদেশ (জিও) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের এ তালিকা দীর্ঘ। পলকের সর্বশেষ দায়িত্বকালের প্রথম ছয় মাসেই অন্তত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন।
অভিযোগ আছে, ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিদেশ পাঠাতে বেশ উদার ছিলেন তিনি। উল্লেখিত সময়ে বিদেশ সফর করেননি আইসিটি বিভাগের এমন এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এমন কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করেছেন, যাদের চাকরির সঙ্গে ওই সফরের কোনো সামঞ্জস্যতা ছিল না।
অবশ্য তিনি শুধু নিজে বা নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ করিয়েছেন তেমনটি নয়, সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, এমন ব্যক্তিদেরও বিদেশ সফরে পাঠিয়েছিলেন বিদেশ ভ্রমণে উদারপন্থি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।