Logo
Logo
×

জাতীয়

এবার মুখ খুললেন গুম হওয়া সাংবাদিক কাজল, দিলেন ভয়ংকর সব তথ্য

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫৮ পিএম

এবার মুখ খুললেন গুম হওয়া সাংবাদিক কাজল, দিলেন ভয়ংকর সব তথ্য

শফিকুল ইসলাম কাজল। ফাইল ছবি

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ৫৩ দিন গুম ছিলেন একটি দৈনিক পত্রিকার আলোচিত ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর গুম নিয়ে মুখ খুলেছেন ভুক্তভোগী এই সাংবাদিক। 

সম্প্রতি ‘টেবিল টক ইউকে’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে গুমের সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কাজল বলেন, আমার ৫৩ দিন চোখ বেঁধে রেখেছে। আমার মুখে বল ঢুকিয়ে রাখত। আমি কথা বলতে পারতাম না, শ্বাস নিতে পারতাম না। আজ যারা কথা বলতে পারছেন, তাদের সবার সঙ্গে এ আচরণ হয়নি। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া গুমের বিষয়গুলো দেখাশোনা করতেন বলে দাবি করেন সাংবাদিক কাজল। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার সাইন (স্বাক্ষর) ছাড়া একটা মানুষ বাংলাদেশে গুম হয়নি’। 

গুমের সময় তাকে কী ধরনের নির্যাতন করা হতো তার বর্ণনা দিয়ে কাজল বলেন, ‘একদিন নামাজের সময় আমি সিজদা দিয়েছি, তখন আমার গলায় পাড়া দিয়ে উঠেছে। আমি আল্লাহকে গোঙড়ায়ে ডাকছি, আল্লাহ আমাকে এখান থেকে বের করে দেন, না হলে মেরে ফেলেন। আগের দিন আমি ক্রসফায়ার হয়ে যেতাম; কিন্তু আল্লাহর অলৌকিক শক্তিতে আমি ফিরে আসছি। মানুষের দোয়াতে আমি ফেরত আসছি। একেবারে সাধারণ মানুষ আমার জন্য দোয়া করেছে। অসহায় মানুষ আমার জন্য কথা বলেছে। ভদ্রলোকেরা সেদিন আমার জন্য কথা বলেনি।’ 

‘সেদিন মানুষ মিন মিন করে কথা বলেছে। আমার অপরাধ কী? আমার অপরাধ কি পাপিয়াদের সঙ্গে রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পর্ক, আমার অপরাধ কি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পাপিয়ার সম্পর্ক, আমার অপরাধ কি শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সম্পর্ক। এটা ছিল আমার অপরাধ। বাংলাদেশের মানুষ সেদিন উঠে দাঁড়াতে পারেনি। আমার সন্তান দাঁড়িয়ে গেছে। আমি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছি, আমার জন্য কোনো মানুষ দাঁড়াবে না। আমার একটা সন্তান আছে, খুব ছোট। আল্লাহ তাকে দাঁড় করায়ে দেন।’ 

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তার জামিনে বাধা দিয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, উনি আমার বউকে ফোন করে বলেন, ‘আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে সবাই বাধা দেয়, তাকে জামিন দেওয়া সম্ভব না’। তারা হাইকোর্টে থাবা মারে যেন আমার জামিন না হয়। 

তিনি আরও বলেন, আমাকে গুম করে নেওয়ার পর যখন নিপীড়ন করে তখন আমি তো মানুষের কাছে ফরিয়াদ করতে পারিনি। আমি তো কোনো মানুষকে বলতে পারিনি। তারপর আমি বলেছি, গুমকে নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। গুম সেন্টার তো অনেক আগেই তৈরি বাংলাদেশে। আমরা যারা আজকে গুম সেন্টার দেখছি, সেটা তো আজকের গুম সেন্টার না। লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে কারাগারে আমার দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, ‘তার আমলেই ১৭-১৮ গুম সেন্টার ছিল’। 

গুম প্রসঙ্গে সাংবাদিক কাজল আরও বলেন, গুমের সময় আমার সঙ্গে কী হয়েছে, সেটার ফুটেজ যদি তারা বের করে দেয়, তখন আমার সঙ্গে কী করা হয়েছে, সেটা হবে ন্যায্য। আমার গুমের সঙ্গে ৩৬ জন নয়, ৫০ জনের অধিক লোক জড়িত। বাংলাদেশের ইতিহাসে সভ্য বা অসভ্য রাষ্ট্রের একজন প্রধানমন্ত্রী বা তার নিচের লেভেলের মানুষের যদি ‘সেক্স স্ক্যান্ডাল’ বের হয়ে যায় তাহলে সেই রাষ্ট্র থাকার কথা নয়।

তিনি বলেন, ছাত্রলীগকে তো চোখের সামনে দেখলেন। হলে হলে যৌন ব্যবসা হয়নি? বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন ব্যবসা গড়ে তোলা হয়নি। সবই তো হয়েছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেনের মেয়েদের যৌনচারের ডকুমেন্ট আমার কাছে ছিল। আমাকে তুলে নিয়ে সেগুলো নিয়ে নিয়েছে।

‘তাদের ধারণা ছিল, আমার কাছে তাদের সব সেক্স ভিডিও রয়েছে। আসলে কি তাই ছিল। না, এটা আতঙ্ক। তারা সবাই পাপাচারে জড়িয়ে গিয়েছিল। তারা কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, তারা আওয়ামী লীগের। আমি তো তাদের তালিকা প্রকাশ করেছি। বাংলাদেশে অনাচার ও ব্যভিচারের বিরুদ্ধে যদি কেউ বিদ্রোহ করে থাকে তাহলে আমি করেছি।’ 
ক্যাসিনোকাণ্ড নিয়ে গুমের শিকার এই সাংবাদিক বলেন, আমি ক্যাসিনোকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যাপক লেখালেখি করেছি। সম্রাট তিন কোটি টাকা জোর করে লাশের গাড়ির ওপর থেকে চাঁদা নেয়। এ বিষয়ে যখন আমি জানাতে গেলাম, তখন শত শত সাংবাদিক আমার বিরুদ্ধে লেগেছিল। সব ঘটনার সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িত। একজন সাংবাদিকের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ আর কথা বলে না। কথা তো আল্লাহ বলাইছেন মানুষকে দিয়ে। একবারে বলাইছেন। সেটা হলো যে, এই যে অভ্যুত্থান- এটা একদিনের নয়। মানুষের সিজদায় সিজদায় গেছে, মানুষের আহাজারিতে গেছে।

৫৩ দিন গুম থাকার পর বের হয়ে আমি আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। তুমিও তোমার সন্তানদের আর কোনো দিন জড়িয়ে ধরতে পারবা না শেখ হাসিনা। আল্লাহ যেন সেই দোয়া কবুল করেন আমার। তুমি মহাব্যভিচারিণী, তুমি গণভবনে যৌনাচার করেছ। তোমার রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে যৌনাচার করেছে। ১৫ আগস্ট একটা প্রাণীও যেন না নামে। ওই ব্যভিচারীর সেন্টার ৩২ নম্বর, ওই ব্যভিচারীর সেন্টার গণভবন। ধ্বংস করে দেওয়া হোক এগুলো। এগুলোতে জনগণ থাকবে। গণভবন মানে জনগণের জায়গা। ওখানে গরিব মানুষের জন্য বিল্ডিং বানিয়ে তাদের থাকতে দেন। 

তিনি আরও বলেন, আমার ছোট একটি সন্তান আছে। আল্লাহ আপনি তাকে দাঁড় করিয়ে দেন। আল্লাহ সেদিন তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষকে সেদিন দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ। আমি সেদিন সিজদায় আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি যে- আল্লাহ এই অনাচারী শাসন, ব্যভিচারিণী শাসন ও যৌনচারিণী শাসন দুনিয়া থেকে বিনাশ করে দাও। আল্লাহ আমার ডাক শুনেছেন।’ 

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে সাংবাদিক কাজল বলেন, আজ যারা সরকারে গেছেন, তারা আমাদের আহাজারির মধ্যে আছেন। আজকে গুমকারীদের এখনো গ্রেফতার করেননি। আপনারা সবাই জানেন, এই আনিসুল হককে (সাবেক আইনমন্ত্রী) জিজ্ঞাসা করুন। ভিডিও-অডিও প্রকাশ হয়েছে। উনি বলেছেন, ‘কাজলকে ক্রসফায়ার করে দেন’। এরা তো সেই লোক, এদের তো ফাঁসি দিলে সব শেষ হবে না। এই শেখ হাসিনাকে আল্লাহ কোনো দিন বাংলাদেশের মাটিতে ফেরত আনবে না। ইতিহাস কোনো দিন বলেনি- ব্যভিচারিণী ফেরত এসেছে। যার পরিবারতন্ত্রের আমি ঘোর বিরোধী। কারণ আমি জানি, সব পরিবারতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থা যৌনাচারের ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়।

আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার উদ্দেশে সাংবাদিক কাজল বলেন, আমার মা, আমার মেয়েদের আহবান- পুরাতন যত রাজনৈতিক দল আছে এদের বিনাশ করে দিছে আল্লাহ। আল্লাহ এদেরকে তোমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি। কারণ আল্লাহ জানেন, এরা যেকোনো সময় বিক্রি হয়ে যাবে। এরা সবাই সুবিধাভোগী। এরা কোনো না কোনো কায়দায় সুবিধাভোগী। 

‘বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমার ডাক, দেশের সরকারের কাছে আমার ডাক, ওখানে (সরকার) গুম হয়ে যাওয়া তিনজন মানুষের প্রতিনিধি আছে। আমার ডাক শুনেন, এই শাসন কুরবানির শাসন, কুরবানি যেভাবে হয় বাংলাদেশে, বাংলার মুসলমানরা যেভাবে কুরবানি দিয়ে বণ্টন করে, সেই শাসন ব্যবস্থা এসেছে। আপনারা নড়চড় করবেন, বিনাশ হয়ে যাবেন। বিনাশ হয়ে যাবেন।’ 

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১১ মার্চ পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকার বাসা থেকে বের হয়েই নিখোঁজ হন ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর ওই বছরের ৩ মে তার খোঁজ মেলে। গভীর রাতে যশোরের বেনাপোল সীমান্তের একটি মাঠ থেকে তাকে উদ্ধার করার কথা বলা হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে।

এরপর এই সাংবাদিককে দুই হাত পেছনে দিয়ে হাতকড়া লাগিয়ে আদালতে নেওয়ার ছবি ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল। পরে ৩ মে থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।
হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে প্রায় ৯ মাস পর ২৫ ডিসেম্বর বাড়ি ফেরেন তিনি। 
এর আগে ১০ মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায়। যুব মহিলা লীগের দুজন নেত্রীও তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা করেছিলেন। কয়েকটি মামলায় ৩ মে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দুটি মামলায় তাকে জামিন দিলে তার মুক্তির সুযোগ তৈরি হয়।

পক্ষকাল নামে একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল একই সঙ্গে দৈনিক খবরের কাগজ ও বণিক বার্তার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতেন।

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম