Logo
Logo
×

জাতীয়

ভারতকে উভয় সংকটে ফেলেছেন শেখ হাসিনা

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৪, ১০:০০ এএম

ভারতকে উভয় সংকটে ফেলেছেন শেখ হাসিনা

ছবি: সংগৃহীত

শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালায়ন করেছেন। বিমানে দিল্লি গেছেন তিনি। তার অবতরণে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য দিল্লি একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।

সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে ক্যাবিনেটের নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে জরুরি বৈঠকেও বসেছিল। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা সবাই উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ঠিক কী করবে, ওই বৈঠকে সে ব্যাপারেও কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।

দিল্লিতে একাধিক পর্যবেক্ষক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি ভারত সরকারকে একটা ‘ক্যাচ টোয়েন্টি টু সিচুয়েশন’ বা চরম উভয় সংকটে ফেলে দিয়েছে, এ কথা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে।

আর এই বিপদটা আসছে দু’দিক থেকে – এক, ব্যক্তি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে দিল্লি কী পদক্ষেপ নেবে আর দুই, বাংলাদেশের ভেতরে যা ঘটছে সেটাকেই বা দিল্লি কীভাবে অ্যাড্রেস করবে।

যেমন, শেখ হাসিনাকে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়াটা ভারতের উচিত হবে কিনা, তা নিয়েও ভারতে দুরকম মতামত শোনা যাচ্ছে। অনেকে যেমন এর পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, আবার এর বিপক্ষেও মত দিচ্ছেন কেউ কেউ।

আবার বাংলাদেশের ভেতরে এই মুহূর্তে যে ধরনের পরিস্থিতির খবর আসছে, সেখানে দিল্লির কী করণীয় আছে তা নিয়েও পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে স্পষ্ট দ্বিমত আছে।

দিল্লিতে বর্তমানে অন্য আর একটি মতবাদ হল, ভারত যদি বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি দেখেও চুপচাপ হাত গুটিয়ে থাকে তাহলে ঘরের পাশে আর একটি মৌলবাদী শক্তির উত্থান অবধারিত, এমন কী লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থীর ধাক্কা সামলানোর জন্যও ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হতে পারে।

সরকারিভাবে ভারত অবশ্য এখনো ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ – অর্থাৎ পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখার কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে, কিন্তু এই পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্কগুলো ভারতকে যে প্রবল দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলেছে তাতে কোনো সংশয় নেই।

শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এই যুক্তিগুলো কী, এই প্রতিবেদনে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

সোমবার বিকালে যখন শেখ হাসিনার গতিবিধি নিয়ে তখনও চরম অনিশ্চয়তা, ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন এমন একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদকে মেসেজ করেছিলাম, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে ঢাকা ছেড়েছেন জানতে পারছি, আপনি কিছু শুনেছেন?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হচ্ছেন ড. ইউনূস

সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংক্ষিপ্ত জবাব দেন, যেখানে খুশি যান, ভারতে না-এলেই হল!

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের জেরে শেখ হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে আসতে হলে সেটা নিয়ে যে দিল্লিতেই একটা প্রবল দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করবে, তা তার ওই মন্তব্যেই স্পষ্ট ছিল।

দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ'র সিনিয়র ফেলো তথা বাংলাদেশ গবেষক ম্ম্রুতি পট্টনায়ক এই কথাটাই আবার বলছেন একদম চাঁছাছোলা ভঙ্গীতে।

তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি শেখ হাসিনা যদি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, তাহলেও ভারতের উচিত হবে না সেটা মঞ্জুর করা।

ড. পট্টনায়ক যুক্তি দিচ্ছেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন হয়েছে তার একটা স্পষ্ট মাত্রা ছিল ভারত বিরোধিতা।

ভারতকে যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসেবে দেখা হত, তাই হাসিনা বিরোধিতার আন্দোলনে স্বভাবতই মিশে ছিল ভারত-বিরোধিতার উপাদান।

স্ম্রুতি পট্টনায়ক বলেন, এই পটভূমিতে ভারত যদি তাকে এখন রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়, সেটা একটা ভুল বার্তা দেবে এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারত বিরোধিতাকে আরও উসকে দেবে।

ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত আবার যুক্তি দিচ্ছেন, ১৯৭৫-এ যে পটভূমিতে শেখ হাসিনাকে ইন্দিরা গান্ধী সরকার ভারতে আশ্রয় দিয়েছিল তার চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা।

তিনি বলেন, তখন যেটা সম্ভব ছিল, এখন সেটা সম্ভব নয়। সে সময়কার মতো শেখ হাসিনাকে তো আর পান্ডারা রোডের একটা ফ্ল্যাটে কার্যত কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই রাখা যাবে না, এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

এই পর্যবেক্ষকরা দীর্ঘমেয়াদে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তি দিলেও সম্পূর্ণ অন্য কথা বলেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।

শুধু অভ্যুত্থান নয়, রাষ্ট্র গঠনের নেতাও পেয়ে গেছি: আসিফ নজরুল

মি শ্রিংলা বলেন, তিনি যদি কোনো কারণে ভারতে থাকতে চান, তার মর্যাদা ও সম্মান অনুযায়ী যথাযথ পর্যায়ে (অ্যাপ্রোপ্রিয়েট লেভেল) তার সঙ্গে আমাদের এনগেজ করতে হবে। এখানে দ্বিতীয় কোনও ভাবনার অবকাশ নেই।

সোজা কথায়, পুরনো ইতিহাস ও এতদিনের সম্পর্ককে মাথায় রেখে তার ইচ্ছাকে ভারতের সম্মান দিতে হবে – এটাই তার যুক্তি।

ভারতে শাসক দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ শুভ্রকমল দত্ত আবার মনে করেন, এখনই স্থায়ীভাবে না-হলেও শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারত তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

ড. দত্ত বলেন, যতদিন না তৃতীয় কোনও দেশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে তিনি আশ্রয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত ভারতের উচিত হবে তাকে সসম্মানে ভারতেই রাখা।

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা মনে করেন, বাংলাদেশে ভারত একটি শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও স্থিতিশীল সরকার চায়, এর মধ্যে কোনও ভুল নেই। আর কোনও দেশই চায় না তার ঘরের দোরগোড়ায় একটি শত্রুভাবাপূর্ণ সরকার থাকুক।

সুতরাং বাংলাদেশে পরবর্তী সরকার যাতে ভারতের প্রতি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ থাকে, তার জন্য যা যা করা উচিত সেটা করা দরকার বলেই মনে করেন তিনি।

কংগ্রেস নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুরও বলেছেন, জামাতের যে ভারত-বিরোধিতার ইতিহাস, তাতে নতুন সরকারে তাদের প্রভাব কতটা হবে সে ব্যাপারে ভারতকে আগেভাগেই সতর্ক থাকতে হবে।

এমন কী, ওই সরকারের ওপর চীন বা পাকিস্তানের মতো শক্তিগুলো কলকাঠি নাড়াতে চাইবে বলেও মনে করেন মি থারুর। কিন্তু জামাতের এই তথাকথিত ‘প্রভাব’ ঠেকানোর জন্য ভারত ঠিক কী করতে পারে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট দিশা দেখাতে পারেননি তারা কেউই।

শ্রীরাধা দত্ত অবশ্য বলছিলেন, বাংলাদেশে কারা এই মুহুর্তে শেষ কথা বলছেন বা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেটা আমরা জানি না। তাদেরকে ভাল করে চিনিও না। আমরা যদি তাদের সঙ্গে একটা সুস্থ ও স্বাভাবিক ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ চাই, তাহলে সবার আগে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

এদিকে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির ভেতর থেকেই কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ‘সফট ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাপ্রোচে’র বদলে ‘কঠোর দৃষ্টিভঙ্গী’ নেওয়ার দাবি উঠছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শীর্ষ নেতা শুভেন্দু অধিকারী যেমন প্রকাশ্যেই বলেছেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের ওপর এখনই চাপ প্রয়োগ করা দরকার – নইলে সে দেশ থেকে অন্তত এক কোটি হিন্দু পালিয়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হবেন।

শুভ্রকমল দত্তও বলছেন, একাত্তরের যুদ্ধও কিন্তু শুরু হয়েছিল শরণার্থী সমস্যা দিয়ে। আমি মনে করি বাংলাদেশের বর্তমান সংকটে ভারতের অনেক আগেই সরাসরি হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল, তখন সেটা না-হলেও এখন কিন্তু করতেই হবে।

ভারত এখন ঠিক কী করছে?
মঙ্গলবার বিকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।

প্রথমত, তার আগের গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ‘কর্তৃপক্ষে’র সঙ্গে ভারত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। তবে এই কর্তৃপক্ষ বলতে সেনাবাহিনী না কি প্রশাসনিক বিভাগ, সেটা তিনি কিছু ভেঙে বলেননি।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্য সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, দোকানপাট বা ব্যবসা এবং মন্দিরে হামলার বহু ঘটনা ঘটেছে বলে খবর আসছে। এই পরিস্থিতির ওপর ভারত সতর্ক নজর রাখছে।

সূত্র: বিবিসি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম