ভবিষ্যতে দমন-পীড়নের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে কোটা আন্দোলনের মামলা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৮:১৭ এএম
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশের ভাষায় তারা দুষ্কৃতকারী। হাতেগোনা কয়েকটি ঘটনা ছাড়া অধিকাংশ হত্যা মামলার বাদী পুলিশ।
এদিকে সুরতহাল প্রতিবেদনেও লাশের শরীরে গুলির চিহ্ন এড়িয়ে গেছে পুলিশ। এমনকি ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ গানশট ইনজুরির (গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু) লেখা থাকলেও সুরতহালে গুলির আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
সহিংসতার ঘটনায় ডিএমপিতে (ঢাকা মহানগর পুলিশ) হত্যা মামলার সংখ্যা ৫৩টি। এতে ৩ পুলিশ সদস্যসহ রাজধানীতে ১৫০ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে পুলিশ। বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী ছাড়াও এদের মধ্যে ব্যবসায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং অজ্ঞাতনামা পথচারী রয়েছেন। তাদের সবার মরদেহ ইতোমধ্যে দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
হত্যা মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৯০ ভাগ মামলায় আসামিদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। আসামির ঘরে অজ্ঞাতনামাদের কথা বলা হয়েছে। ফলে এসব মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে হয়রানির আশঙ্কা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। এমনকি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে এসব মামলা।
এজাহারে কোথাও পুলিশের গুলির কথা নেই
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগ থেকে জানা যায়, সহিংসতার ঘটনায় ডিএমপির (ঢাকা মহানগর পুলিশ) বিভিন্ন থানায় এখন পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ২৭৪টি। দণ্ডবিধির ১৪৩, ১৪৭, ১৮৪ ১৪৯ ৩০৭ ও ৩০২ সহ আরও বেশকিছু ধারায় এসব মামলা করা হয়েছে। এতে বৈআইনি জনতাবদ্ধ হয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সরকারি কাজে বাধা, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫৩টি হত্যা মামলা।
পুলিশ জানায়, আন্দোলনে সহিংস হয়ে ওঠা যাত্রাবাড়ীতে সর্বাধিক ১৬টি হত্যা মামলা করা হয়েছে। এছাড়া কদমতলীতে ৪, বাড্ডায় ৫, ভাটারায় ৩, পল্টন ও নিউমার্কেটে ৬টি, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও কাফরুলে যথাক্রমে ২টি করে এবং খিলগাঁওয়ে, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, হাতিরঝিল, উত্তরা পশ্চিম ও পূর্ব থানায় ১টি করে হত্যা মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ হত্যা মামলার সংখ্যা তিনটি।
এজাহার বিশ্লেষণ দেখা যায়, বেশিরভাগ হত্যা মামলায় দুষ্কৃতকারী হিসাবে সন্দেহভাজন তৃতীয় পক্ষের কথা বলা হয়েছে। তবে তাদের কারও নাম-ঠিকানা উল্লেখ করেনি পুলিশ। এছাড়া প্রায় সব মামলায় কোটা আন্দোলনের আড়ালে বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীদের তৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়। মামলার কোথাও পুলিশের গুলির কথা বলা হয়নি। যদিও সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ছবি ও ভিডিও চিত্রে বিক্ষোভ দমনে পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে (বিজিবি-বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে দেখা গেছে।
সুরতহাল
এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এজাহার ছাড়াও বেশিরভাগ সুরতহাল প্রতিবেদনেও লাশের শরীরে গুলির চিহ্ন এড়িয়ে গেছে পুলিশ। ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে লাশের সুরতহাল করেন শাহবাগ থানার এসআই সানারুল হক। এতে বলা হয়, ‘মৃতের কপালসহ সাদা রাউন্ড ব্যান্ডেজ। খুলে দেখা যায় যে, মাথা কামানো চুল নেই। ডান কানের ওপর পর্যন্ত ডাক্তার কর্তৃক ৩৫টি সুতার সেলাই। যা লম্বা অনুমান ১২ ইঞ্চি। মাথার বাম পাশে কালো দাগ দেখা যায়। বাম চোখ কালো এবং ফোলা জখম। বাম কানে রক্ত। মুখ ফোলা।
১৮ জুলাই রাজধানীর প্রগতি সরণিতে সহিংসতায় জনৈক হাসান নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে ১৯ জুলাই তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর কারণ হিসাবে হাসপাতালের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয় ‘গানশট ইনজুরি’। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এমনকি লাশের শরীরে থাকা গুলির কথাও উল্লেখ করেনি পুলিশ।
১৯ জুলাই গুলশানের শাহজাদপুর সুবাস্তু নজরভ্যালি শপিংমলের সামনে গুলিবিদ্ধ হন ওয়াসিম নামের এক যুবক। পরে ঢাকা মেডিকেলে কলেজে তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালের নথিতে তার মৃত্যুর কারণও গানশট। কিন্তু পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে ওয়াসিমের শরীরের কোথাও গুলির চিহ্ন উল্লেখ করা হয়নি। ২০ জুলাই লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়, মাথার পেছনে রক্তাক্ত নানা জখম, যাহা লম্বা অন্তত ৩ ইঞ্চি, কপাল স্বাভাবিক, উভয় চোখ খোলা, বুক পেট পিঠ, গলা ও ঘাড় স্বাভাবিক।
এজাহারের কোথাও পুলিশের গুলির কথা উল্লেখ না থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বৃহস্পতিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। আশা করি তদন্তে সবকিছুই স্পষ্ট হবে। পুলিশ যদি আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়ে থাকে তবে সেটিও তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আবার যারা পুলিশকে হত্যা করেছে সেটিও বের হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকেও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি কাজ করছে।