আর একটিও গুম, অপহরণ, হত্যা নয়: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ০৬:৫০ পিএম
সারাদেশে হত্যা-গুম-গণগ্রেফতারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ এবং আটককৃতদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত শতাধিক শিক্ষক।
সোমবার দুপুর সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ থেকে এ দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সমাবেশ থেকে সারাদেশে হত্যা-গুম-গণগ্রেফতারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ এবং আটককৃতদের মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে৷ এছাড়াও জুলাই মাস জুড়ে সংঘটিত মৃত্যুর ঘটনাকে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ বলে আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষকরা। সমাবেশে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতাও পালন করেন তারা।
সমাবেশে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. আবদুল হাসিব চৌধুরী বলেন, আজকে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক মিথ্যার ওপরে। একটা উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, তা হলো আবু সাঈদের এফআইআর। দেশে যা ঘটছে সাধারণ মানুষ এখন মনে করে পুলিশ যা বলে সব মিথ্যা।
তিনি আরও বলেন, দুই ধরনের জায়গা দখলের চেষ্টা চলছে। মনোভূমি আর জমিন। মনোভূমি দখলের জন্য সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন এবং মিডিয়া কাজ করে। এই মনোভূমি থেকে সরকারি লোকজন উচ্ছেদ হয়ে গেছে। সরকারের বয়ান, তাদের রাজনীতির স্থান ছাত্রদের মনোভূমিতে নেই। আর জমিন রক্ষায় চলছে বল প্রয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হলো। কারণ তা না হলে জমিন রক্ষা করতে পারবে না।
শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালে অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। আমরা এখানে যারা জমায়েত হয়েছি আমরা শহীদ শামসুজ্জোহার উত্তরসূরি। আমাদের ছাত্ররা যে অধিকারের জন্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরই উত্তরসূরি। এই লড়াইয়ের ফলাফল কী হবে সেটা ইতিহাসই আমাদেরকে নির্দেশ করছে, আমাদের করণীয় কী সেটাও ইতিহাসই আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করব।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, মিথ্যার প্রচারণা যারা করছেন এটা একসময় তাদের বিরুদ্ধেই বুমেরাং হবে। রাখালবালককে সত্যি সত্যি বাঘে ধরলে কেউ বিশ্বাস করবে না… আজকে ১৫ বছর-১৭ বছরের বাচ্চাকে বলেন রাজাকার। আর একাত্তরের পরে যারা জন্ম নিয়েছে তাদের বলেন মুক্তিযোদ্ধা।
‘ছাত্রদের নামে মামলাবাজি বন্ধ করুন। মোবাইল দেখে ঘর থেকে তুলে নিয়ে আসছেন। ৫ কোটি মানুষের মোবাইলে আন্দোলনের কোনো না কোনো ছবি পাওয়া যাবে। ৫ কোটি লোককে জেলে দেবেন?,’ প্রশ্ন করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাসুদ ইমরান বলেন, আমি এখানে কোনো বিচার চাইতে আসিনি, আমি ঘৃণা জানাতে এসেছি। এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঘৃণা জানাতে এসেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্য সমন্বয়কদের নিয়ে রাতে যখন নাটক চলছিল তখন আমি ওই ছেলেটির মুখটিও খুঁজছিলাম। কিন্তু তাকে দেখা যায়নি। ওকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। ও গেল কোথায়? আরও অনেক শিক্ষার্থীকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা গেল কোথায়?
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার লাল সালাম। তারা যা করেছে ঠিকঠাক করেছে, যা করছে ঠিকঠাক করছে। ডিবি অফিসে তাদের আটকে রেখেছে, বয়ান দেয়াচ্ছে। তারা তো বলেই দিল আন্দোলন থেকে সরে গেলাম। এটাই তো আপনারা চাচ্ছিলেন। কই এখন পর্যন্ত তো ছাড়া হলো না! তাদের বাবা-মা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, একটা আইনব্যবস্থার মধ্যে একটি রাষ্ট্রে জোর করে মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে একটি সংস্থা। আমাকেও হয়তো রাস্তা থেকে তুলে নেবে কেউ জানতেই পারবে না। এটা কোন দেশে আছি? কোথায় আছি? আর কতদিন এভাবে চলবে? এই রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার চেতনাজীবী, বুদ্ধিজীবী সবার প্রতি ঘৃণা জানাচ্ছি। ঘৃণা জানাবার জন্যই এখানে এসেছি কোনো বিচার চাইতে আসিনি।
ঢাবির আরেক শিক্ষক চৌধুরী সায়েমা ফেরদৌস বলেন, বিচার কার কাছে চাইবো, কোথায় চাইবো? আমরা ঘৃণা জানাই। ক্যাম্পাসে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঞ্চনা হয়েছে। আমি সারারাত ঘুমাতে পারি না। যে বাবা-মায়ের বুক খালি হয়েছে তাদের ঘরের কী অবস্থা! আপনারা আমাদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন না। জন্মেছি একবার, মরবও একবার, ভয় দেখাবেন না।
সমাবেশে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সংবাদকর্মীদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন শিক্ষকরা। সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দেশের মানুষের কথা বলার আহ্বান জানানো হয়।
ঢাবি অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, বিদেশি পত্রিকা, টেলিভিশনে খবর দেখে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক অধ্যাপক আমাকে ইমেইল করেছে। সে চিন্তিত বাংলাদেশ নিয়ে। আমার দেশের শিক্ষকরা কোথায়? এখানে কেন এই অল্পসংখ্যক শিক্ষক?
‘বাংলাদেশের টেলিভিশন দেখলে মনে হয় অন্য গ্রহে আছি। সম্পদ নষ্ট হচ্ছে দেখানো হয়… সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা কোনো চাকরি না। এখানে দায়িত্ব আছে। এই দুই অর্গান যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন রাষ্ট্র ভালো থাকতে পারে না। তার উদাহরণ আজকের বাংলাদেশ।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, চুপ থাকা অন্যায় কিন্তু এর চেয়েও বড় অন্যায় মিথ্যা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া। আশা করি আজকের পর থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলো টেলিভিশন হয়ে উঠবে।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাঈদ ফেরদৌস বলেন, সরকার ভুল পথে নয়, মিথ্যাচারের পথে হাঁটছে। প্রথমদিনে ছাত্রলীগ, হেলমেটবাহিনী, বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের, শিক্ষকদের পিটিয়েছিল। সেটার পরই যদি সরকার সংশোধন করে নিত আমরা বলতাম ভুল। ভুল তো বারবার হয় না। আর এটা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র। অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া—এই শপথ নিয়ে তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকেন তারা এতবার ভুল করতে পারেন না। তারা দিনের পর দিন যে কাজটা করছেন সেটা ভুল না তারা সুস্পষ্টভাবে মিথ্যাচার করছেন।
‘সরকার দেখাতে চেয়েছে নাহিদ ইসলাম বিবৃতি পড়ছে যে আন্দোলন তুলে নেওয়া হলো। আমরা তো দেখেছি নাহিদের হাতে পায়ে সারা শরীরের কী পরিমাণ জখম।’
‘আর একটিও গুম, অপহরণ, হত্যা নয়’ জানিয়ে তিনি বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুলে নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্বীকারও করে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিফ সোহেলের কোনো খবর পাচ্ছি না। ভয় দেখানো, আমাদের সহকর্মীদের নামে জিডি, হামলা-মামলা ভয় দেখিয়ে কতদূর যাবেন? শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবির প্রতি আমরা সমর্থন জানাই।
শহরজুড়ে ব্লক রেইড, আতঙ্কে নগরবাসী
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সাইমুম রেজা, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ নাহিদ নেওয়াজি, গ্রিন ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক মনিরা শরমিন, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষক অলিউর সানসহ আরও অনেকে।
সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের দুই সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন ও সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার সংশ্লিষ্টতা স্থাপনের অভিযোগে দায়ের করা জিডির নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি পাঠ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা। রাজধানীর শাহবাগ থানায় গত ২৪ জুলাই এই জিডি করেন ঢাবির আরেক শিক্ষক সোনম সাহা।