ফাইল ছবি
বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই ভূমিকম্প ও দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। আবার মানবসৃষ্ট নানা কারণেও ঘটছে বিপর্যয়। সাধরণত অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প, ভবনধস, পাহাড়ধসসহ যে কোনো দুর্যোগে প্রাথমিক ডাক পড়ে ফায়ার সার্ভিসের। তখন সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনসহ অন্য সংস্থাগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ে না।
অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা চালালেও সংস্থাটির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অভিযোগ রয়েছে, আগুন নিভে যাওয়ার পরে কিংবা ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরে হাজির হয় ফায়ার সার্ভিস। রানা প্লাজাধস, নিমতলী ট্র্যাজেডি, এফআর টাওয়ার ও চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক বহু ঘটনায় সংস্থাগুলোর সক্ষমতায় প্রশ্ন তুলেছে মানুষ।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প, বিস্ফোরণ, পাহাড়ধসসহ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বড় ধরনের ঝুঁকির ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রস্তুতি তেমন নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড না মানা, বাড়তি জনসংখ্যা, দুর্বল ও ভঙ্গুর গ্যাস-বিদ্যুৎ-সুয়ারেজ লাইন, দুর্ঘটনা-পরবর্তী জরুরি উদ্ধারে কেন্দ্রীয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকা, দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবল-সরঞ্জামের অভাবসহ নানা কারণ এর জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এক ছাতার নিচে আনাসহ বিভাগ সংশ্লিষ্ট দক্ষ ও যোগ্য জনবল তৈরির পাশাপাশি আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মেহেদী হাসান আনসারী যুগান্তরকে বলেন, বড় বিপর্যয় মোকাবিলায় শুধু ফায়ার সার্ভিস নয়, কোনো সংস্থারই পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই। এক্ষেত্রে দক্ষ জনবল ও আধুনিক সরঞ্জামের অভাব অনেক বড়। পাশাপাশি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করেছেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিস ও নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শহর থেকে গ্রামে অধিকাংশ ভবন জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি না হওয়ায় ঝুঁকি অনেক বেশি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তথ্যে দেখা গেছে, রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোতে বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ৪০ হাজারের অধিক ভবন যথাযথ বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) আলী আহমেদ খান যুগান্তরকে বলেন, উন্নত দেশে সবকিছু নিয়ম মানা হলেও বাংলাদেশে অনেকে নিয়ম মানেন না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবগুলো সংস্থা নিজেদের দায়িত্ব কঠোরভাবে পালন করাসহ সমন্বিত মনিটরিং বাড়ালে বড় দুর্যোগের আগে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে আগুনের ঘটনা ঘটে ১ লাখ ৩৮ হাজার ১১৬টি। এতে ক্ষতি হয় ২ হাজার ৩১৬ কোটি টাকার বেশি। আহত হন ২ হাজার ৮২৩ ও নিহত ৮৭৪ জন। একই সময়ে অগ্নিকাণ্ড ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা ঘটে ৬০ হাজার ২৭৯টি। যেখানে ১২ হাজার ৬২ জনের মৃত্যু হয়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ আগুন নেভানোর পরেও সব ঘর পুড়ে গেছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দ্রুত সময়ে ফায়ার সার্ভিস এলেও ৪৬ জনের মৃত্যু হয়।
ফায়ার সার্ভিসে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৫ জন। যেখানে কর্মরত আছে ১৩ হাজার ৭৮৪ জন। পদ ফাঁকা আছে ৭৩১টি। সারা দেশে গাড়ি, অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জামসহ সব মিলিয়ে যন্ত্রপাতি আছে ৪ হাজার ৭১৪টি। এর বেশিরভাগই ঢাকার ফায়ার স্টেশনে। দেশের ৪৯২টি ফায়ার স্টেশনের মধ্যে ১১২টিই ঢাকায়। সারা দেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২০টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৯টি।
এর মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের দুটি ল্যাডার কেনা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসহ সংস্থাগুলোতে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল এবং আধুনিক সরঞ্জাম বাড়াতে হবে।