সিপিডির সংলাপে বক্তারা
মূল্যস্ফীতি ও ঋণঝুঁকিই অর্থনীতির বড় সমস্যা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৪, ০৮:৪৭ পিএম
ছবি-যুগান্তর
বর্তমানে খুবই জটিল, আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশ। অর্থনীতির দিক থেকে সমস্যাগুলোর ত্রিযোগ ঘটেছে। যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের ঝুঁকি এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির নিুগতি। বিশ্বব্যাপী ভূরাজনীতিতে কঠিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশ থেকে বাড়ছে টাকা পাচার। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবকিছু নেতিবাচক। বিদ্যুৎ বিল, সুদহার, মুদ্রার বিনিময় হার এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। অপরদিকে প্রণোদনা ও মার্কেট একসেস কমবে। অর্থাৎ সব সমস্যা একত্রিত হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় অপচয়, অদক্ষতা এবং সুশাসনের অভাব। এ অবস্থায় নতুন সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে অপচয় রোধ, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাত সংস্কারে নিতে হবে বড় উদ্যোগ।
রোববার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম আয়োজিত সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংলাপের বিষয় ছিল-‘নতুন সরকার, জাতীয় বাজেট ও জনমানুষের প্রত্যাশা’। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী সরকারদলীয় সংসদ-সদস্য এমএ মান্নান, স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য ও হা-মীম গ্র“পের চেয়ারম্যান একে আজাদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এছাড়াও বক্তব্য দেন সিপিডির আরেকজন বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি এবং বিদেশি দূতাবাস ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, খুবই জটিল, আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ বছর নতুন বাজেট আসছে। নতুন সরকার এ বাজেট দিচ্ছে। আর সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাগরিক সন্তুষ্টি হয়তো উচ্চপর্যায়ে নেই। কিন্তু তারা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় দেশ পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, এ বছরের বাজেটের সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যেমন : আমাদের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা) থেকে উত্তরণ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষের দিকে। নতুন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের কিছু প্রত্যাশা আছে। এছাড়াও এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক কঠিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফলে কাজগুলো খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।
তিনি বলেন, অর্থনীতির দিক থেকে সমস্যাগুলোর ত্রিযোগ ঘটেছে। ইংরেজিতে বললে ‘ট্রাংগুলেশন অব প্রবলেমস’। অর্থাৎ, তিনটি সমস্যা একত্রিত হয়েছে। এ সমস্যার মধ্যে একটি গত বছরই ছিল, যা হলো উচ্চমূল্যস্ফীতি। ইতোমধ্যে যা মানুষকে আঘাত করছে। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও এখনো মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। এটি গ্রাম ও শহরে সব জায়গায়ই বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, ক্রমান্বয়ে আমাদের ঋণের ঝুঁকি বাড়ছে। এটি শুধু বিদেশি ঋণ নয়, এখানে দেশি ঋণও রয়েছে। কারণ, সরকার বিদেশ থেকে যে টাকা নেয়, এর দ্বিগুণ নেয় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এ দায়দেনা পরিস্থিতি বড় ধরনের সমস্যার ইঙ্গিত নিয়ে আসছে। তৃতীয় বিষয় হলো, জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে ধারা ছিল, সাম্প্রতিক সময়ে সেখান থেকে কিছুটা কমেছে। এছাড়াও কর আহরণ ও সরকারের খরচ করার ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। এ তিন সমস্যা আগামী বাজেটকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। এগুলো মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে ক্ষয় করছে। এ মূল্যস্ফীতি দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষকে অত্যন্ত বিরূপভাবে আঘাত করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন মূল্যস্ফীতি কমছে, তখন সেই সুফল বাংলাদেশের মানুষ পাচ্ছে না।
তার মতে, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে। বর্তমানে জিডিপির ৩৭ শতাংশের সমান ঋণ রয়েছে। পাশাপাশি আরও ব্যক্তি খাতের ঋণ ৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেশি-বিদেশি মিলিয়ে বর্তমানে ঋণ জিডিপির প্রায় ৪২ শতাংশের সমান। এতে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। টাকার মান কমছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এতদিন আমরা বলতাম বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কোনোদিন খেলাপি হয়নি। কিন্তু এখন জ্বালানি খাতের জন্য আমরা যে ঋণ নিয়েছি, এর অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার দিতে পারছি না। আমদানি বিল পরিশোধ হচ্ছে না। বিদেশি কোম্পানি মুনাফাও নিতে পারছে না। অর্থাৎ আমাদের গর্বের জায়গা ছিল, বিদেশে ঋণখেলাপি হইনি। সেই জায়গায় কিন্তু চিড় ধরেছে। এর বাইরে প্রবৃদ্ধির হারে শ্লথগতি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশে চলে এসেছে। কিন্তু সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাকি সময়ে ১০ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি থাকতে হবে। সবাই জানে, এটি বাস্তবসম্মত নয়।
এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে-সরকারের ব্যয়যোগ্য সম্পদ সীমিত, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কম। প্রশ্ন হলো-প্রবৃদ্ধি ধারা কি সাময়িক? এটি দুই-এক বছরে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, এটি আগামী বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তার ওপর নির্ভর করছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আজ আলোচনার আরেকটি বিষয় হলো মানুষ কী ভাবছে। এক্ষেত্রে নাগরিক প্ল্যাটফরমের পক্ষ থেকে একটি জরিপ করেছিলাম। সেখানে আড়াই হাজারের মতো লোক অংশ নিয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে প্রশ্ন ছিল, বাজেটে প্রত্যাশা কী। ৪৪ শতাংশ বলেছে, তাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। যাদের প্রত্যাশা আছে, তাদের প্রথম চাওয়া হলো শোভন কর্মসংস্থান। দ্বিতীয় চাওয়া মানসম্মত শিক্ষা। তৃতীয় সম্প্রসারিত সামাজিক সুরক্ষা। তাদের চতুর্থ চাওয়া হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৩, স্বাস্থ্য খাতে ২ এবং সামাজিক সুরক্ষায় ৩ শতাংশ বরাদ্দ জরুরি।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, করোনার সময়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। এরপর আজকের অবস্থানে কেন এলো। তিনি বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবকিছু নেতিবাচক। বিদ্যুৎ বিল, সুদহার, মুদ্রার বিনিময় হার এবং মজুরি বেড়েছে। অপরদিকে প্রণোদনা এবং মার্কেট একসেস কমবে। অর্থাৎ সব সমস্যা একত্রিত হয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনীতি কীভাবে সম্প্রসারণ হবে? এর সবকিছুর পেছনে সুশাসনের অভাব দায়ী। প্রতিটি খাতে অপচয়, অদক্ষতা এবং সুশাসনের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় বাজেটে বেশকিছু ভালো কর্মসূচি নেওয়া হলো। কিন্তু এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেটি বড় প্রশ্ন। তিনি বলেন, কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আগের অবস্থায়। এরপরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যায়নি। কোথায় যাচ্ছে এ বিদেশি মুদ্রা? আজ এ প্রশ্নগুলো আমাদের সামনে আসছে। কারণ, দেশ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা বাইরে পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, আজ দেশে যে সংকট, এর পেছনে দায়ী আমাদের আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব। দুর্বল ১০টি ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলোর কথা ১০ বছর আগে থেকে বলা হচ্ছে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ব্যাংকে এসব সমস্যা হয়েছে। দুর্বল এ ১০ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও মূলধন ঘাটতি আছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। সবমিলিয়ে ৮৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) সন্তুষ্ট করার জন্য ৯ শতাংশ খেলাপি থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এই ৪ শতাংশ টক্সিট এসেটের (বিষাক্ত সম্পদ) দায় কে নেবে? এজন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি কী হবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে না। অন্যদিকে আমাদের কর্মসংস্থান বেশি হয় এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা) খাতে। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিল এবং ঋণের সুদ দ্বিগুণ। এ অবস্থায় কে বিনিয়োগে আসবে? ব্যাংকের সুদের হার ৯ শতাংশ থাকা অবস্থায় যেখানে বিনিয়োগ হয়নি, সেখানে ১৪ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে বিনিয়োগ সম্ভব? ডলারের দাম ৮৫ থেকে ১১০ টাকায় চলে গেছে। আনঅফিশিয়ালি সেটি ১২০ টাকার ওপরে। এটি উদ্যোক্তাদের ওপর বড় ধরনের শক বা আঘাত। এতে শিল্প খাত টিকে থাকবে কীভাবে? মূল্যস্ফীতি কমছে না। এর প্রধান কারণ সিন্ডিকেট। ভোগ্যপণ্য আমদানি করে হাতে গোনা ৬ থেকে ৭জন। আগে এটা ছিল না। এখানে প্রতিযোগিতা ছিল। ভারত ও শ্রীলংকায়ও মূল্যস্ফীতি কমছে। সিন্ডিকেটের কারণে আমরা পারছি না। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। এখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির সংযোগ রয়েছে। এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মূল্যস্ফীতি কমবে না।