প্রতীকী ছবি
বগুড়ার শাজাহানপুরে নুরুজ্জামান নুরু ওরফে ঠ্যাংকাটা নুরু উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে পুরো এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। টেন্ডারবাজি, মাটির ব্যবসা, মাদক ব্যবসা ও জমি দখল তার নিত্যকাজ। দীর্ঘদিন এসব থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে প্রশাসন, ক্যাডার ও দলীয় গডফাদারদের লালন-পালন করে আসছেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগে জামায়াত-বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করেছেন।
সর্বশেষ দলীয় সন্ত্রাসীকে ছাড়িয়ে নিতে শনিবার থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশ সদস্যদের আহত, মহাসড়ক অবরোধ করে শক্তির জানান দিতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। পুলিশ নুরু ও তার সহযোগী হাসান নাজমুলের বাড়ি থেকে ১৫ রাউন্ড গুলি ভর্তি দুটি বিদেশি পিস্তল ও মাদক উদ্ধার করেছে। পুলিশ বাদী হয়ে নুরু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে এবং পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে শনিবার রাতে দুই মামলা করেছে। গ্রেফতার নয়জনকে আদালতে হাজির করে সাত দিন করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ-পদবি থেকে তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পরে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রে জানানো হয়েছে।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিড়া ইউনিয়নের মাঝিড়াপাড়ার দিনমজুর মৃত খাজা মিয়ার ছেলে নুরুজ্জামান নুরুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। ১৯৯০ সালের দিকে তিনি শাজাহানপুরের সন্ত্রাসী সাজেদুর রহমান মুন্নার সহযোগী ছিলেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান নুরুর উত্থান ঘটে জমি দখল, মাদক ব্যবসা করে। প্রায় ২০ বছর আগে তিনি শাজাহানপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জামায়াত আমির ইয়াসিন আলীর ছেলে শিবির ক্যাডার রুবেলের সহযোগী ছিলেন। জেলা আওয়ামী লীগের এক দায়িত্বশীল নেতার হাত ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ মাঝিড়া বন্দর কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। এরপর তার ব্যক্তিগত উন্নয়নের পালে হাওয়া লাগে। বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে যান। শাজাহানপুর উপজেলা সদরের মাঝিড়া থেকে বনানী, ফুলতলা, ফুলদীঘি, শাকপালা, নয়মাইল, আড়িয়াবাজার, সাবরুলসহ বিভিন্ন এলাকা নুরু ও তার বাহিনীর কথায় চলে।
জামায়াত-বিএনপির নাশকতার মোকাবিলা করে তিনি ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের নজরে আসেন। নেতাদের আশীর্বাদে শাজাহানপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করলেও নুরুর বেশি সখ্য ছিল জামায়াত-বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে। ছাত্রদলের দুর্ধর্ষ ক্যাডার সাইদুর রহমান খোকন, ওহাবুজ্জামান নাইম, জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আবদুর রহমানের ছেলে ছাড়াও সরকারবিরোধী অনেককে স্বেচ্ছাসেবক লীগে নেন।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে ৫৭টি ক্লাব গড়ে তোলেন। নুরুর বিশ্বস্ত লোকজন এসব ক্লাব পরিচালনা কমিটিতে স্থান পান। ক্লাবগুলোর সদস্য সাত হাজারেরও বেশি। প্রত্যেকটি ক্লাবের ২-৩ জন মাদক ব্যবসায় জড়িত। এরা অন্য ব্যবসায়ীদের পুলিশে ধরিয়ে দেন। আবার নুরু টাকার বিনিময়ে থানায় তদবির করে তাদের ছাড়িয়ে নেন। অবৈধ অর্থ দিয়ে প্রশাসন ও সন্ত্রাসী লালন করেন। বর্তমানে তিনি কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করেন। ফেসবুক আইডিতে বড় বড় শীর্ষ নেতা ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে নুরুর ছবি দেখা যায়। পরে মাঝিড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। গত বছরের মার্চে শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদে প্রকাশ্য টেন্ডার শিডিউল চুরি করে ধরা পড়েন। এ ব্যাপারে মামলা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল। নিজ এলাকায় এক তরুণীকে ধর্ষণ করে আলোচনায় আসেন নুরু। পরে ওই পরিবার বাড়িঘর বিক্রি করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। নুরুর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ রেজাউল, জুয়েল ও সাজুর পা কেটে দেওয়ায় তার নাম ঠ্যাংকাটা নুরু হয়ে যায়। নুরু ও তার বাহিনীর অত্যাচার এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিছুদিন আগে উপজেলার ডোমনপুকুর এলাকায় সাবেক সেনা সদস্য সোহেল রানার জায়গা থেকে ৩১টি মূল্যবান আকাশমনি গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাজাহানপুরের মাঝিড়াপাড়া ও রহিমাবাদ এলাকায় কয়েকজন বলেন, বর্তমানে নুরু বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। মাঝিড়া বন্দরে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ছয় শতক জমি দখল করে সেখানে চারতলা ভবন ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। সেখানে নিজস্ব কার্যালয় ও দাদন ব্যবসাও রয়েছে। এক সময় দরিদ্র থাকলেও শুধু অপরাধের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদ গড়ে এখন কোটি টাকা মূল্যের দুটি গাড়িতে চলাফেরা করেন। কয়েকটি ট্রাক, ইটভাটা, ঠিকাদারি ব্যবসা ও ডোমনপুকুরে প্রায় চার একরের পুকুর রয়েছে।
নিজ কার্যালয়ে রোববার বিকালে বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, শাজাহানপুর থানার এসআই আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে একদল ফোর্স শনিবার রাতে আড়িয়া বাজার থেকে দুটি বার্মিজ চাকু ও দেশীয় অস্ত্রসহ হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি আড়িয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মিঠুনকে গ্রেফতার করে। রাত ১০টার দিকে অন্তত ৪০টি মোটরসাইকেলে শাজাহানপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঝিড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরুর নেতৃত্বে তার সন্ত্রাসী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য গ্রেফতার মিঠুনকে ছিনিয়ে নিতে থানায় যান। তারা ওসি শহিদুল ইসলামকে ধাক্কা দিয়ে পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। এতে কয়েকজন কর্মকর্তাসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের তৎপরতায় পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নুরু ও তার বাহিনীর সদস্যরা থানা থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আবারও মিঠুনকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় হামলার জন্য নুরু ও তার লোকজন মাঝিড়াপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির কাছে মহাসড়কে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গেলে তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এক পর্যায়ে মহাসড়কে অবস্থানকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে নুরুজ্জামান নুরু ছাড়াও তার বাহিনীর সদস্য সাদ্দাম হোসেন রবিন, রমজান আলী, সাইদুর রহমান খোকন, বোরহান উদ্দিন, সেরাজুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, মো. মিতুল ও ওহাবুজ্জামান নাইমকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনাস্থলে ফেলে যাওয়া ৩৬টি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। পরে নুরুর স্বীকারোক্তিতে তার মাঝিড়াপাড়ার বাড়ি থেকে সাত রাউন্ড গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল ও তার ম্যানেজার, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান নাজমুলের বাড়ি থেকে আট রাউন্ড গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল, তিন বোতল ফেনসিডিল ও এক কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
শাজাহানপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, নুরুর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্রবাজি, জমি দখল, সরকারি কাজে বাধা, মাদকদ্রব্য আইনে অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে।