রসু খাঁ, এরশাদ শিকদার, বাবু শেখ বা মাহফুজ-সবারই ছিল বিকৃত ইচ্ছা। অস্বাভাবিক মনোবাসনার কারণে তারা হয়ে উঠেছিলেন সিরিয়াল কিলার। আর তাদের আদলে মানুষ খুন করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন হওয়ার স্বপ্ন ছিল রাজধানীর দক্ষিণখানের এসএম ওয়াহিদ হোসেন ওরফে পুলকের।
ইচ্ছা পূরণের যথেষ্ট উপদান আছে তার মধ্যে। মাদকের নেশার চেয়েও তার কাছে বেশি নেশা জমেছিল মানুষ হত্যার।
প্রথম খুন করার পর সে তার মাকে জানিয়েছিল, একে একে নিজ চাচার পরিবারের সবাইকে (পরিবারের নয় সদস্য) হত্যা করবে। এরপর এলাকার অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেবে। উত্তরা অপরাধ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর চেষ্টা চালাবে পুরো ঢাকার অপরাধ জগতের ডন হওয়ার। তার থাকবে গাড়ি-বাড়ি এবং লাশঘর। কিন্তু অঙ্কুরেই বিনাশ হয়েছে পুলকের এই স্বপ্নের।
নিরাপত্তাকর্মী হত্যা মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল ২১ মার্চ দক্ষিণখান বাজার এলাকা থেকে পুলককে গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছে একটি লোহার ছুরি পাওয়া যায়।
গ্রেফতারের পর ডিবির জিজ্ঞাসাবাদের হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানায় পুলক। বর্ণনা করে খুনি হয়ে ওঠার লোমহর্ষক ঘটনা।
ডিবি জানায়, ২০১০ সালে পুলকের বাবা মারা যান। এরপর তার চাচা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করেন। এতে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। একপর্যায়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন হওয়ার পরিকল্পনা করে।
গত ১৮ মার্চ দক্ষিণখান থানায় একটি মামলা করেন খোরশেদা নামে এক নারী। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিদিনের মতো ১৭ মার্চ তার স্বামী আফিল মিয়া নাইট ডিউটি করতে রাত ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে দক্ষিণখান বাজারে যান। ওইদিন রাত আড়াইটার দিকে রফিকুল ইসলামের মাধ্যমে জানতে পারেন, তার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় দক্ষিণখান চেয়ারম্যান বাড়ি জামে মসজিদের পাশে পড়ে ছিল। স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাকে কেসি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। সেখান থেকে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। খোরশেদা সেখানে গিয়ে তার স্বামীকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। জানতে পারেন, অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা তাকে বুকের বামপাশে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে।
ঘটনার পর থানা পুলিশ, পিবিআই, সিআইডি এবং ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। আলামতের পাশাপাশি আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে। এলাকার নিরাপত্তাকর্মীদের তালিকা সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেয়। পরবর্তীতে ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হত্যাকারী হিসাবে পুলককে চিহ্নিত করে ডিবি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আফিল মিয়া এবং এসএম ওয়াহিদ হোসেন পুলক একই এলাকার বাসিন্দা। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। পুলক মাদকাসক্ত ও বেকার যুবক। মাদকাসক্ত হওয়ায় পুলককে তার চাচা আফিল প্রায়ই শাসন করত। মাঝেমধ্যে গালাগাল করত। এতে পুলকের মনে ক্ষোভ জন্মে।
ঘটনার দিন পুলক তার বন্ধু কায়েস ও লিয়নকে নিয়ে স্থানীয় এমরাত হোসেন স্কুল মাঠে ইয়াবা সেবন করে। রাত ২টার দিকে আফিল মিয়াকে চেয়ারম্যান বাড়ি জামে মসজিদের সামনে চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখতে পায়। রাত সোয়া ২টার দিকে সে আফিল মিয়ার সামনে যায়। কথা বলার একপর্যায়ে তার কোমড়ে থাকা ছুরি দিয়ে আফিল মিয়ার বুকে আঘাত করে। এতে ভিকটিম মাটিতে লুটে পড়ে।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সাইফুল আলম মুজাহিদ যুগান্তরকে বলেন, পুলকের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল-সে দক্ষিণখানে কসাইবাড়ী থেকে উত্তরখানে কাঁচমুগা পর্যন্ত এলাকার অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। তাকে সবাই এক নামে চিনবে। পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কথায় উঠবে-বসবে। তার একটা লাশঘর থাকবে। যেখানে সব সময় ৪-৫টি লাশ থাকবে। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক। মানুষ হত্যাকে সে নেশায় পরিণত করতে চেয়েছিল। ইয়াবা সেবন করে সে যে ‘পিনিক’ পেয়েছে, মানুষ হত্যা করে তার চেয়ে বেশি ‘পিনিক’ পেয়েছে বলে পুলক ডিবিকে জানিয়েছে।