সোমালি উপকূলে জিম্মি এমভি আবদুল্লাহ
অভিযান পরিকল্পনার খবরে নাবিকদের পরিবারে উদ্বেগ
মজুমদার নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩৯ পিএম
সোমালিয়া উপকূলে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে মুক্ত করতে অভিযান চালানো হতে পারে-এমন খবরে জাহাজটির নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে-এ ধরনের তৎপরতার পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নাবিকদের মুক্ত করে আনার পক্ষে তারা।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এর আগে ২০১০ সালে একই প্রতিষ্ঠানের একটি জাহাজ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ১০০ দিনের মাথায় সেই জাহাজের নাবিকদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল মালিকপক্ষ। যেহেতেু তাদের আগের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই এক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে জিম্মি উদ্ধারের চেষ্টা চালানো উচিত।
এদিকে শিপিংসংশ্লিষ্টরাও এই মুহূর্তে অভিযানের পক্ষে নন। তাদের ভাষ্য, জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূল থেকে মাত্র চার নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে। ওই এলাকায় জলদস্যুদের শক্ত অবস্থান। সেখানে অভিযান চালিয়ে সুবিধা করা যাবে না। উলটো ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তারাও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এবং জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে রয়টার্সের বরাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আবদুল্লাহতে অভিযানের এই পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে চট্টগ্রামভিত্তিক কবীর গ্র“পের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে। নাবিকদের সবাই বাংলাদেশি। জাহাজটি বর্তমানে সোমালিয়া উপকূলের গারাকাড এলাকা থেকে উত্তর দিকে ৪৫-৫০ মাইল দূরে গদবজিরান উপকূলের কাছাকাছি রয়েছে।
শনিবার সোমালি উপকূলে ৪০ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে এমভি রুয়েনকে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করে ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডোরা। জাহাজটির ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পাশাপাশি জাহাজে থাকা ৩৫ জলদস্যুর সবাইকে তারা আটক করে। তিন মাস আগে আরব সাগরে মাল্টার পতাকাবাহী ওই জাহাজ দখল করে নেওয়ার পর নাবিকদের জিম্মি করে রেখেছিল জলদস্যুরা।
এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আকিকুল্লাহ খানের ভাই আসিফ নূর মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, জিম্মি জাহাজটিতে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা হচ্ছে, এমন খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা এ ধরনের অভিযানের পক্ষে নই। কারণ সর্বশেষ যখন আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে তিনি জানিয়েছিলেন জাহাজে অবস্থানরত দস্যুদের হাতে ভারী অস্ত্র রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো অভিযান চালানো হলে তারাও পাল্টা জবাব দেবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি জাহাজের মালিকপক্ষও অভিযানে আগ্রহী নয়। আমরা মনে করি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জিম্মিদের মুক্ত করে আনাটাই সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
অসিফ বলেন, আমরা জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, আলাপ-আলোচনার জন্য বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
তিনি জানান, সর্বশেষ গত শনিবার চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছিল। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, জাহাজে কয়েকদিনের মধ্যে পানি ও খাবার সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়া জলদস্যুরা নাবিকদের চলাফেরায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
এদিকে এমভি আদুল্লাহর অয়েলার শামসুদ্দিন সোমবার রাত ৯টার দিকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। ওই সময় তিনি জানান, দস্যুরা আগের চেয়ে আরও কঠোর হয়েছে। কথা বলার সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন বলে পরিবারের সদস্যরা জানান।
এমভি আবদুল্লাহতে অভিযানের পরিকল্পনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘জাহাজটি সোমালি টেরিটোরির মধ্যে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভূমি থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সাগর ও আকাশপথ ওই দেশের অংশ। এক্ষেত্রে অভিযান চালাতে হলে সোমালি সরকারের অনুমতি লাগবে। এছাড়া আবদুল্লাহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারেরও অনুমতি নিতে হবে। যদি অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তাহলে এর দায় কে নেবে। আমার জানামতে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত এ ধরনের অভিযানের অনুমতি দেয়নি। তাই আমার মনে হয়, অভিযানের বিষয়টি শুধু পরিকল্পনাতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।’
এমভি রুয়েন আর এমভি আবদুল্লাহর অবস্থানগত প্রেক্ষাপট ভিন্ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুটো জাহাজকে একসঙ্গে মিলালে হবে না। রুয়েন নামের যে জাহাজটি উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি তিন মাস ধরে সোমালি উপকূলে ছিল। যেখানে এটাতে অভিযান চালানো হয়েছে, সেটা উপকূল থেকে সাড়ে ৩০০-৪০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। সেখানে কানো জুরিসডিকশন ছিল না। এমভি আবদুল্লাহ সমতলের কাছাকাছি, প্রায় ৪ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে। এখানে সোমালি জলদস্যুদের শক্ত অবস্থান রয়েছে। এখানে বাইরের কেউ এসে অভিযান চালালে তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তাহলে জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারের উপায় কী, জানতে চাইলে এই মেরিনার বলেন, এখনো পর্যন্ত জলদস্যুদের হাত থেকে যতগুলো মুক্তির ঘটনা ঘটেছে, তার ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশই হয়েছে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে। এর কোনো বিকল্প নেই।
তিনি নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের উদ্বিগ্ন না হয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।
জাহাজ মালিক-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নাবিকদের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে এমন কোনো পদক্ষেপ বা অভিযানের পক্ষে তারা নন। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে তারা নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চান।