গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। স্বাধীন গণমাধ্যম জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, শিক্ষিত ও অধিকারসচেতন করে। রাজনৈতিক দলগুলোর যৌক্তিক আন্দোলন কর্মসূচি সফল করতেও স্বাধীন গণমাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশের গণমাধ্যম মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় অর্জনে উজ্জীবিত করেছিল। এক্ষেত্রে ওই সময়ের কিছু দৈনিক পত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ স্বাধীন করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তবে দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পর নির্বাচিত সরকার আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে সে উদ্যোগ সফল না হলেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বিভিন্ন শাসনামলে সরকারি হস্তক্ষেপ করা হতে থাকে।
বর্তমান সরকার প্রায় একনাগাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতায় আছে। এ সরকার আমলেও গণমাধ্যমকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বন্ধও হয়ে গেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর পত্রিকাগুলোকে অদৃশ্য চাপের মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। অনেক সময় প্রতিপক্ষ থেকে সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে অপব্যাখ্যা করা হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে স্বাধীন মতামত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পত্রিকার সম্পাদকরা কতটা সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন, সে প্রশ্নও রয়েছে। যে কোনো সমাজে কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে থেকে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করা চ্যালেঞ্জিং কাজ। অধিকাংশ পত্রিকা স্রোতে গা ভাসালেও কয়েকটি পত্রিকা বিরূপ পরিবেশেও যতদূর সম্ভব সঠিক সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুগান্তর এ রকম পত্রিকার মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে।
আমি নিজে যুগান্তর পত্রিকার একজন পাঠক ও লেখক। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহতভাবে যুগান্তরে কলাম লিখছি। ফলে যুগপৎ দেশে ও বিদেশে লাখো পাঠক আমাকে যুগান্তরের একজন কলামিস্ট হিসাবে জানেন। তাদের অনেকের কাছেই আমার নির্বাচিত কলাম ‘দেশপ্রেমের চশমা’ যথেষ্ট পরিচিত। আমি অবশ্য অনেক কলামিস্টের মতো সাধারণ পাঠকদের জন্য কলাম লিখি না। তত্ত্ব, তথ্য ও বিশ্লেষণের সমন্বয়ে আমার কলামগুলো মূলত বোদ্ধা পাঠকদের জন্য লিখিত। তবে সাদামাটা বর্ণনা ও বিশ্লেষণের কারণে কলামগুলো সাধারণ পাঠকরা বুঝতে পারেন। দেশ ও জাতির জন্য যা ভালো মনে করি, তা স্বাধীনভাবে লিখতে চেষ্টা করি। এ কারণে আমার কলাম প্রকাশিত হলে আমি ফিডব্যাক হিসাবে সাধারণ পাঠকদের প্রতিক্রিয়া পাই। অনেকে আমাকে ই-মেইল করে লেখা সম্পর্কে নানা রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। যুগান্তরে কলাম লিখে আমি দেশি ও বিদেশি পত্রিকা পাঠকদের কাছে অনেক সম্মান পেয়েছি। আমার যে লেখক পরিচিতি রয়েছে, তা যুগান্তর অনেকটা প্রসারিত করেছে। যুগান্তরে প্রকাশিত আমার অনেক লেখা পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা অনুমতি না নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করে। এমন ঘটনা জেনেও আমি প্রতিবাদ করি না। কারণ, আমি চাই যুগান্তরে প্রকাশিত আমার লেখাগুলো সবাই পড়ুক। আলোচনা-সমালোচনা করুক। যুগান্তরে লিখে আরেকটি কারণে আমি অধিক পরিচিতি পেয়েছি। সেটি হলো, পত্রিকাটি অনলাইনে বহুল পঠিত। দৈনিক ৫০ থেকে ৭৫ লাখ পাঠক সারা বিশ্বে এ পত্রিকা অনলাইনে পড়েন।
পত্রিকা হিসাবে যুগান্তর যথেষ্ট উদার। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগ চাপের মধ্যে কাজ করলেও আমার লেখা অধিকাংশ সময় অপরিবর্তিত অবস্থায় প্রকাশ করেন। এক যুগেরও বেশি সময় এ পত্রিকায় আমার লেখা শত শত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যুগান্তরে প্রকাশিত এসব কলামে আমি যে পরামর্শ দিয়েছি, তা অনেক সময় সরকার আমলে নিয়েছে। যুগান্তর পত্রিকায় নানা রকম লেখক কলাম লিখে থাকেন। রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সাংবাদিকসহ অনেক শ্রেণিপেশার লেখক এ পত্রিকায় লিখে থাকেন। যুগান্তরের নিয়মিত কলামিস্টরা সমসাময়িক বিষয়ের ওপর সব সময় বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখে থাকেন। যে কেউ চাইলেই এ পত্রিকায় মানসম্পন্ন উপযোগী লেখা প্রকাশ করতে পারেন। কোনো কোনো পত্রিকার মতো, আমার জানামতে, এ পত্রিকায় ‘লেখক ঘরানা’ তৈরি করা হয় না। পলিসিগত কারণে অনেক পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ না করে এড়িয়ে গেলেও যুগান্তর সাধারণত তা করে বলে মনে হয় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, গত সংসদ নির্বাচনের সময় যুগান্তর নির্বাচনি অনিয়ম তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। নির্বাচনের ওপর আমার এবং আরও অনেক কলামিস্টের বিভিন্ন বাস্তবোচিত গঠনমূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করে যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগ এ সময় সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণে পত্রিকাটি পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং ধন্যবাদ পেয়েছে।
যুগান্তরের পাঠকপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো এর নির্মোহ সংবাদ উপস্থাপন ও তার গঠনমূলক বিশ্লেষণ। যুগান্তর তার সংবাদ পরিবেশনায় সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়। এর সম্পাদকীয় পাতায়ও একই রীতি অনুসরণ করা হয়। এর ফলে যুগান্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঠকরা সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে বাস্তবোচিত ধারণা পান। এসব কারণেই যুগান্তর পাঠকের মাঝে জনপ্রিয়তা নিয়ে ২৫ বছর ধরে টিকে আছে এবং এর জনপ্রিয়তা যুগপৎ দেশে ও বিদেশে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বর্তমানে দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংকুচিত হয়ে আসছে। এ জায়গাটিতে যুগান্তরসহ সব জাতীয় দৈনিকের অধিকতর মনোযোগী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
যুগান্তরের সাহিত্য পাতা পাঠকদের সাহিত্য পিপাসা মিটিয়ে চলেছে। সাহিত্যের পাতায় প্রকাশিত গল্প, কবিতা ও অন্যান্য বিষয় মানসম্পন্ন। তবে অন্য পত্রিকার মতোই সাহিত্যের পাতায় স্রোতের অনুকূলে রচিত সাহিত্য অধিক হারে প্রকাশিত হচ্ছে। দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলমান থাকায় প্রতিবাদী সাহিত্য সংকুচিত হয়ে আসছে। সাহিত্যে সমাজের প্রেম-ভালোবাসা, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ, বেদনা যেমন উঠে আসা উচিত, একইভাবে সাহিত্যে সামাজিক নৈরাজ্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, গণতন্ত্রহীনতার চিত্রও ঠাঁই পাওয়া উচিত। অধিকাংশ পত্রিকারই এক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগী ও যত্নবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
যুগান্তরের ঈদসংখ্যা ও বর্ষপূর্তিসংখ্যাও যত্নসহকারে আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশ করা হয়। এসব বিশেষ সংখ্যায় দেশের স্বনামধন্য লেখক ও গবেষকরা তাদের লেখা প্রকাশ করেন। আমি নিজে ঈদসংখ্যায় না লিখতে পারলেও একাধিকবার যুগান্তরের বর্ষপূর্তি সংখ্যায় লিখেছি। বিশেষ সংখ্যার লেখাগুলোও বহুল পঠিত হয়। সব মিলিয়ে যুগান্তর একটি উন্নতমানের সাহসী ও পাঠকপ্রিয় পত্রিকা হিসাবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে।
আজ ১ ফেব্রুয়ারি যুগান্তর ২৫ বছরে পদার্পণ করল। একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ২৪ বছর সুনামের সঙ্গে পথচলা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এর জন্য যে ত্যাগ ও নিষ্ঠার প্রয়োজন, যুগান্তর পরিবারের সবাই মিলে সে প্রয়োজন মেটাতে পেরেছেন। এ কারণেই পত্রিকাটি পাঠকপ্রিয় হয়েছে। পত্রিকাটির শুভ জন্মদিনে এর মালিক, সম্পাদক ও পাঠকরা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক নৈরাজ্য দূর করে আগামী দিনগুলোতে দেশকে সুশাসন ও মসৃণ গণতন্ত্রের ওপর চলমান রাখতে যুগান্তর অধিকতর গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করি। আমি নিজে যুগান্তর পত্রিকার একজন পাঠক ও লেখক হিসাবে এ পত্রিকার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। পত্রিকাটির এই শুভ দিনে যুগান্তর পরিবারের সব সদস্যকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : সাবেক সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com