যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র হিমেলকে অপহরণ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:২৩ পিএম
বহুল আলোচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হাসিবুর রহমান হিমেলকে অপহরণের পর পাশবিক কায়দায় নির্যাতন ও মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় অপহৃতকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আর অপহরণ চক্রের মূল হোতা মালেকসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
মূলত, হিমেলের বাবার ব্যাটারি ব্যবসার আয়ের টাকা থেকে বড় অংকের মুক্তিপণ আদায় করতে তাকে অপহরণ করা হয়।
গ্রেফতার ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পারে যে, অপহরণ চক্রের মূল হোতা গ্রেফতার মালেক এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছামিদুল। ছামিদুল হিমেলের বাসায় ৪ বছর ধরে গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করায় সুসম্পর্ক তৈরি হয় এবং তাদের পারিবারিক আর্থিক ও সম্পত্তিসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সে জানত। গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে মালেকের নেতৃত্বে গ্রেফতারকৃতরা উত্তরার একটি জায়গায় সমবেত হয় এবং গ্রেফতারকৃত মালেক ও ছামিদুল হিমেলকে অপহরণ করে তার পরিবারের নিকট থেকে বিপুল অংকের মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনার বিষয়টি তাদের অন্যান্য সহযোগীকে জানায়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছামিদুল ভিকটিম হিমেলকে শেরপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাটারি বিক্রয়ের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে শেরপুরে যেতে আগ্রহী করে। গত ২৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় হিমেল শেরপুর যাওয়ার উদ্দেশে রওনা করলে ছামিদুল মালেককে বিষয়টি অবহিত করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গ্রেফতার মালেক ও অন্যান্য সহযোগী ৩/৪টি মোটরসাইকেলযোগে ভিকটিমের গাড়ি অনুসরণ করতে থাকে এবং গাজীপুরের সালনা এলাকায় পৌঁছলে গ্রেফতার ব্যক্তিরা মোটরসাইকেল দিয়ে ভিকটিমের গাড়িটি আটকায়। এ সময় তারা হিমেল ও ছামিদুলকে গাড়ির পেছনে বসায় ও রনি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে এবং রাসেল গাড়ি চালাতে থাকে। মালেক ও অন্যরা মোটরসাইকেলযোগে গাড়িটি অনুসরণ করতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা ধোবাউড়ায় পৌঁছায়। গ্রেফতার রাসেল ও বিল্লাল তাদের ধোবাউড়ায় পৌঁছে দিয়ে গাড়িটি নিয়ে গাজীপুরের বাসন এলাকায় রাখে এবং বিল্লাল পুনরায় ময়মনসিংহ চলে যায়।
মালেক, ছামিদুল ও অপহরণ চক্রের অন্যরা ভিকটিম হিমেলকে নিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় চলে আসে। রনি তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা ও রাস্তাঘাট ভালোভাবে চিনত। তারা ভিকটিম হিমেলকে নিয়ে সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় পরিবর্তন করে অবস্থান করতে থাকে। এ সময় তারা ভিকটিম হিমেলকে পাশবিকভাবে নির্যাতন করে এবং তার ভিডিও ধারণ করে।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, মালেক ভিকটিম হিমেলের মাকে একটি বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থেকে ফোন করে ভিকটিমকে অপহরণের বিষয়টি জানিয়ে ভিকটিমের পরিবারের কাছে প্রথমে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে এবং তার ছেলেকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়। পর্যায়ক্রমে সে ১ কোটি তার পর ৫০ লাখ তার পর ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে। গ্রেফতারকৃতরা ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা না পেলে ভিকটিমকে হাত-পা কেটে ফেলা ও হত্যার হুমকি প্রদান করে। মালেক বিভিন্ন সময় ভিকটিমের মাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়। পরে ভিকটিম হিমেলের মা অপহরণকারীদের মুক্তিপণের টাকা দিতে সম্মত হয় এবং তারা গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে আসতে বলে। বিষয়টি তিনি র্যাবকেও অবহিত করেন। পরে ২৩ জানুয়ারি হিমেলের মা নেত্রকোনায় পৌঁছালে মালেক ও ছামিদুল তাকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে আসতে বলে।
তখন র্যাবের একটি আভিযানিক দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে তাদের গ্রেফতার করতে গেলে তারা র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে র্যাবের আভিযানিক দলের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালায়। র্যাবের আভিযানিক দল মালেক ও ছামিদুলকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভিকটিম হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে পাহাড়ি টিলা এলাকা থেকে উদ্ধার করে এবং অপহরণ চক্রের সদস্য রনিকে গ্রেফতার করে। মালেকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতরাতে রাসেল ও বিল্লালকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
উল্লেখ্য, ভিকটিমকে উদ্ধারকালে ভিকটিমের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ও মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভিকটিম হিমেলের বাবা ব্যাটারি বিক্রয়ের ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ভিকটিম হাসিবুর রহমান হিমেল রাজধানীর উত্তরার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৪র্থ বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। ভিকটিমের বাবা ৪ মাস আগে মৃত্যুবরণ করার পর তার ছেলে ভিকটিম হিমেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তার বাবার ব্যবসা পরিচালনা করতেন।