‘টাকা জমাচ্ছি আল্লাহর কাছ থেকে বাবাকে কিনে আনব’
বাবার জন্য ছোট্ট তানহার আকুতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫৮ পিএম
‘মেয়েটা চাতক পাখির মতো অধীর আগ্রহে বসে থাকে ওর বাবা কখন বাড়ি ফিরে আসবে। কেউ টাকা দিলে তা জমিয়ে রাখে। জিজ্ঞাসা করলে বলে-আমি টাকা জমাচ্ছি, আল্লাহর কাছ থেকে বাবাকে কিনে আনব তাই। মেয়ের খুব শখ বড় হয়ে বাবার মতো পুলিশ হবে। আমার মেয়ে বলে, বড় হয়ে পুলিশ হয়ে বাবা হত্যার বিচার করবে।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে রোববার শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলছিলেন ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের দিন হত্যাকাণ্ডের শিকার পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলাম পাভেজের স্ত্রী রুমা আক্তার।
এ সময় সঙ্গে তার ৭ বছরের মেয়ে তানহা ইসলামও উপস্থিত ছিল। ছোট্ট তানহাও সবার কাছে আকুতি জানায় বাবাকে ফিরে পাওয়ার।
রুমা আক্তার বলেন, ‘আমাদের সুন্দর একটা পরিবার ছিল। পাখির মতো একটা মেয়ে। সেই মেয়ে আজও বসে থাকে, তার বাবা কখন আসবে। বলে, চলো আমরা আব্বুকে নিয়ে আসি।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? কেন তাকে হত্যা করা হলো? সে তো কোনো রাজনীতি করত না। তাকে কেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হত্যা করা হলো? আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই-আমিরুলকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যাকারীদের যেন তার চেয়েও কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়।’
‘মায়ের কান্না’ ও ‘অগ্নি-সন্ত্রাসের আর্তনাদ’ নামের দুটি সামাজিক সংগঠন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় হত্যার শিকার বাংলাদেশ সেনা ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের স্বজন এবং সাম্প্রতিককালে নাশকতার ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য এবং আহতদের বেশ কয়েকজন তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। এসব ঘটনার জন্য তারা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বিএনপি ও জামায়াতকে অভিযুক্ত করে বিচার দাবি করেন।
সম্প্রতি বিএনপির অবরোধ চলাকালে অছিম পরিবহণের একটি বাসে আগুন দেওয়া হলে তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার আবু নাঈম পুড়ে মারা যান। অনুষ্ঠানে নাঈমের মা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলাম-বিএনপি মানুষ পুড়িয়ে মারছে। আমার ছেলেকে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর কঠিন বিচার চাই। তারা যাতে বুঝতে পারে সন্তান হারানো মায়ের কষ্ট কি-সেজন্য তাদের কঠিন বিচার চাই।’
মনোহরদী উপজেলার ব্যবসায়ী সায়েম বলেন, ২০১৩ সালে রাস্তায় গাছ ফেলে অবরোধ করেছিল বিএনপি-জামায়াতের লোকজন। ওই সময় একজন মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল যেতে চাইলে তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। এ কারণে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় তারা। এরপর আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। ২০১৩ সালে শাহবাগে বিহঙ্গ বাসে পেট্রোল বোমা মারা হয়। সেই বাস থেকে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খোদেজা নাসরিন কোনোভাবে বের হলেও সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
তিনি বলেন, সে দিনের আগুনে আমার দুটি হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। মানবাধিকার দিবসে আমার একটাই দাবি, অগ্নিসন্ত্রাস যারা করছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হোক।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জিয়াউর রহমানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের বিচার, ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা এবং ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালের অগ্নিসন্ত্রাসের ওপর তথ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে তারা বক্তব্য দেননি।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারানা হালিম, শহিদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার মেয়ে সংসদ-সদস্য নাহিদ ইজাহার খান, শহিদ বুদ্ধিজীবী আব্দুল আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী।
শাহবাগে মানববন্ধন, অগ্নিসন্ত্রাসে জড়িতদের বিচার দাবি: ঢাবি প্রতিনিধি জানান, এদিন শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এবং সাম্প্রতিক ‘অগ্নিসন্ত্রাস’র সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে ‘২১ আগস্টের ভুক্তভোগী পরিবার, জিয়ার শাসনকালে রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার এবং বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারবর্গ’ ব্যানারে মানববন্ধন হয়। এতে নিহত সার্জেন্ট হাশেম মজুমদারের সন্তান মামুনুর রশীদ মামুন, আকবর আলী খানের সন্তান মুনীম, চাকরিচ্যুত সার্জেন্ট আব্দুল গণি, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবি সিদ্দিকের সন্তান মাসুমা বেগম বক্তব্য দেন।
মানববন্ধনে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ১৯৭৭ সালে জাপানি বিমান হাইজ্যাকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর ১৫শ মুক্তিযোদ্ধা সদস্যকে হত্যা করে। পরিবারের কাছে লাশও হস্তান্তর করা হয়নি। তাদের হত্যা করে জিয়াউর রহমান মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছিল। জাতীয় ৪ নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হয়। তখন কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলেনি।
মানববন্ধনে ‘মায়ের কান্না’ সংগঠনের আহ্বায়ক মো. কামরুজ্জামান লেলিন বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, তখন মানবাধিকার কোথায় ছিল? জিয়ার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুসারী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মীকে হত্যা ও অসংখ্য নেতাকর্মীকে আহত করা হয়েছে। তখন দেশের সুশীল সমাজ ও সংগঠনগুলো মানবাধিকারের কথা বলেনি।