চার বছর পর খুনের রহস্য উদঘাটন
লঞ্চের কেবিনে খুন করে ব্রুনাই যান দেলোয়ার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:২৪ পিএম
চার বছর আগে ঢাকার সদরঘাটে মিতালি-৭ লঞ্চের কেবিনে খুন হন লিলুফা বেগম (৫৭)। খুনী মোঃ দেলোয়ার মিজি (৪৪) কেবিনটি নিজের নামে না নিয়ে লিলুফার প্রতিবেশি জাহাঙ্গীরের নামে নেন। এরপর খুন হওয়া নারী মোবাইলসহ বিভিন্ন আলামত গায়েব করে পালিয়ে যান ব্রুনাই। জাহাঙ্গীরকে নিয়ে চলতে থাকে তদন্ত। এতে তার সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্তে উঠে আসে দেলোয়ারের নাম। তদন্তের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে দেলোয়ারের অপেক্ষায় থাকে পিবিআই।
গত মাসের শেষ দিকে দেশে ফিরলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন পুলিশকে জানান, পরকীয়া সম্পর্কে জড়ানোর পর বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় স্বামীহীন লিলুফাকে হত্যা করেন দেলোয়ার।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পিবিআই সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি জানান, গত ২২ সেপ্টেম্বর ব্রুনাই প্রবাসী আসামী মোঃ দেলোয়ার মিজিকে গ্রেফতার করে পিবিআই ঢাকা জেলা। আসামী দেলোয়ার মিজি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার মোল্লাবাড়ি নাসিরকোর্ট গ্রামের মৃত আঃ মান্নানের ছেলে। ভুক্তভোগী লিলুফা বেগমের বাড়িও একই এলাকায়। ২০১৯ সালের ১৬ জুন রাত ১০টার দিকে ঢাকায় আসার জন্য মিতালি-৭ লঞ্চের এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন লিলুফা। পরদিন সকাল ৯টার দিকে লঞ্চের কেবিন বয় ভুক্তভোগীর লাশ দেখতে পায়। পিবিআই’র ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে পরিচয় সনাক্ত করে।
পিবিআই জানায়, ভুক্তভোগীর ভাই মনির হোসেন বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। লঞ্চের বুকিং রেজিস্টারে প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নামের পাশে ভুক্তভোগীর মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। নিহত লিলুফা বেগমের সঙ্গে তার প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের সখ্যতা থাকায় এ ঘটনায় জাহাঙ্গীর জড়িত থাকতে পারে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এতে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যে জাহাঙ্গীর ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। তদন্তে একই গ্রামের দেলোয়ার মিজির সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর প্রায় সাড়ে চার বছর অপেক্ষার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
পিবিআই আরও জানায়, দেলোয়ার মিজি লিলুফা হত্যাকাণ্ডে দায় স্বীকার করেন। তিনি জানান, দেশে আসার কিছু দিন আগে তিনি তার এক আত্মীয়কে একটি ভয়েস রেকর্ডেড মেসেজ পাঠান। তাকে লিলুফা হত্যা মামলার খোঁজ খবর নিতে বলে। মামলা শেষ করতে যদি টাকা পয়সাও লাগে সেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলে। দেশে আসলে সমস্যা হবে না এমন আশ্বাসে সে ব্র“নাই থেকে বাংলাদেশে আসে।
যেভাবে হত্যা
জিজ্ঞাসাবাদে আসামী দেলোয়ার মিজি আরো জানায়, ভুক্তভোগী লিলুফা বেগমের স্বামী ২০১৫ সালে মারা যান। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। ২০১২ সালের দিকে ভুক্তভোগীর বাড়িতে কাঠ মিস্ত্রীর কাজের সুবাদে তার সঙ্গে ভুক্তভোগীর পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে। ২০১৭ সালে সে ব্রুনাই চলে গেলে ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথা বার্তা চলতে থাকে। আসামী দেলোয়ার মিজি ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ২ মাসের ছুটিতে দেশে আসে। দেশে আসার পর সে ভুক্তভোগী লিলুফার সাথে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করে। ভুক্তভোগী লিলুফা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। সে বিয়ে করবে বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকলে ভুক্তভোগী লিলুফা তার বাড়িতে গিয়ে উঠবে বলে হুমকি দিতে থাকে। দেলোয়ার মিজির বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হলে লিলুফা বেগম সেখানে গিয়ে সম্পর্কের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দিবে বলে হুমকি দেয়। দেলোয়ার মিজি ভুক্তভোগীকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলে এবং বিদেশ যাওয়ার আগেই তাকে বিয়ে করে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্ত করে। ভুক্তভোগী লিলুফা আসামীর থেকে ১৩ বছরের বড় হওয়ায় দেলোয়ার মিজি এই বিয়েতে রাজী ছিলনা। আসামী মান সম্মানের কথা চিন্তা করে ভুক্তভোগীকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
পিবিআই জানায়, পরিকল্পনা মোতাবেক আসামী দেলোয়ার মিজি এবং লিলুফা ঘটনার দিন চাঁদপুর থেকে মিতালি লঞ্চের ৩য় তলার কেবিনে ওঠে। লঞ্চ ছাড়ার পর রাত ১২টার দিকে সে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে লিলুফাকে ধর্ষণ করে। রাত দেড়টার দিকে বিয়ের কথা নিয়ে ভুক্তভোগীর সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সে ভুক্তভোগীর গলা চেপে ধরে। পরে ভুক্তভোগীর গলায় ওড়না পেচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। ভুক্তভোগীর সাথে তার সম্পর্কের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ভুক্তভোগীর মোবাইলে থাকায় সে ভুক্তভোগীর সাথে থাকা দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে গাবতলীতে তার আত্মীয়ের বাসায় চলে যায়। ঐ দিনই সে চাঁদপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। ঘটনার নয়দিন ভুক্তভোগীর মোবাইল ফোন দুটি নিয়ে ব্রুনাই চলে যায়।