নির্বাচন সামনে রেখে তদবিরে মরিয়া এমপিরা
দুদকে দায়মুক্তির হিড়িক
‘ক্লিনচিট’ পেয়েছেন ৮ জন, চূড়ান্ত দেনদরবার করছেন আরও ৩ জন * বর্তমান ও সাবেক ১৪ এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুদকের অনুসন্ধান জালে আটকা বেশ কয়েকজন সংসদ-সদস্য নিজেদের রক্ষায় দৌড়ঝাঁপ ও তদবির শুরু করেছেন। ইতোমধ্যেই সফলও হয়েছেন সাবেক ও বর্তমান আট সংসদ-সদস্য। বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের দায়মুক্তির সনদ বা নির্দোষ হিসাবে অভিযোগ পরিসমাপ্তির চিঠি দিয়েছে।
এসব সংসদ-সদস্যরা এখন দল ও নিজ অনুসারীদের কাছে ক্লিন ইমেজের নেতা হিসাবে প্রচার চালাচ্ছেন। এখনো যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান, তাদের মধ্যে রয়েছেন ৬ জন বর্তমান ও ৮ জন সাবেক সংসদ-সদস্য। এই তালিকার অন্তত তিনজন সংসদ-সদস্য দায়মুক্তির সনদ পেতে প্রভাবশালীদের দিয়ে দুদকের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের এক সংসদ-সদস্য ক্লিন সার্টিফিকেট পেতে প্রয়োজনে কোটি টাকা ঢালতেও রাজি-দুদকের ভেতরে-বাইরে এমন গুঞ্জনও রয়েছে।
জানা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান তাদের কেউ কেউ সরাসরি দুদকে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সরাসরি ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলাপ করে বোঝাতে চেষ্টা করছেন তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজন অভিযোগ করেছে। আবার কেউ অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নাম ভাঙিয়েও কেউ কেউ তদবির করছেন।
দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায় মুক্তি পেতে দৌড়ঝাঁপের তালিকায় রয়েছেন ভোলা-৩ আসনের সংসদ-সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ-সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ। এরা সবাই সরকারি দলের সংসদ-সদস্য। এরমধ্যে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধান চলমান থাকা অবস্থায় জমা হওয়া আরেকটি অভিযোগ আমলে নিয়ে আগের নথির সঙ্গে সংযুক্ত করে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয় কমিশন। ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন করে এই অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর থেকেই শাওন নিজেকে রক্ষার চেষ্টা তদবির চালাচ্ছেন।
এছাড়াও রাজশাহী-১ আসনের সংসদ-সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী, মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার সংসদ-সদস্য মাহী বি চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান। তারাও অভিযোগ পরিসমাপ্তির জন্য চেষ্টা করছেন। অভিযোগ অনুসন্ধানের এই তালিকায় সাবেক ৮ সংসদ সদস্য রয়েছেন। তারা হলেন-বিএনপির আসাদুল হাবিব দুলু, মো. শহিদুজ্জামান বেল্টু, জাতীয় পার্টির এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, আওয়ামী লীগের কামরুল আশরাফ খান পোটন, শামসুল হক ভূঁইয়া, মো. শাহজাহান ও আবদুল মোমিন তালুকদার খোকা।
জানা গেছে, গত দেড় বছরে দুদক থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন ৮ জন সংসদ-সদস্য। সবশেষ ১২ জুন দায়মুক্তি সনদ পান নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু। তার বিরুদ্ধে দুদফা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান হলো। দুবারই তাকে ‘ক্লিনচিট’ দেয় দুদক। এর আগে বিভিন্ন সময়ে দায়মুক্তির সনদ পেয়েছেন, জাতীয় সংসদের হুইপ, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ-সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, ভোলা-৪ আসনের সংসদ-সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ-সদস্য আফজাল হোসেন, শেরপুর-১ আসনের সংসদ-সদস্য আতিউর রহমান আতিক ও চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা, সাবেক সংসদ-সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও বিএম মোজাম্মেল হক।
সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুনাম ক্ষুন্ন করতে একাধিকবার আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। যে ধরণের অভিযোগ করা হয়েছে দুদক তাদের তদন্তে কোন তথ্য-প্রমাণ না পেয়ে আমাকে অব্যাহতি দিয়েছে।
দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কাউকে বিশেষ খাতির বা আলাদা করে সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অভিযুক্ত কোনো এমপিকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য কোনো চাপ নেই, অনৈতিক সুবিধা নেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।’ যাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, ‘কোনো গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বা প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসে না।
দুদক নিজস্ব আইন ও বিধি অনুসরণ করে কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। অভিযোগের বিষয়ে আমলযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলে, অনুসন্ধান কর্মকর্তারা সেই অভিযোগ পরিসমাপ্তির জন্য প্রতিবেদন জমা দেন। সব অভিযোগের ক্ষেত্রেই এই আইন বা বিধি অনুসরণ করে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালানো হয়।’ সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ঠিকাদারি কাজের কমিশন বাণিজ্য, সরকারি সম্পত্তি দখল, ঘুস নিয়ে চাকরি দেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ আসে দুদকে। সেগুলো যাচাই-বাছাই শেষে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়। এরপর থেকে শুরু হয় প্রভাবশালীদের চাপ।
জানা গেছে, যেসব সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান বা যারা দায়মুক্তি পেয়েছেন তাদের দুর্নীতির খতিয়ান রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও রয়েছে। অভিযোগ থেকে তারা কিভাবে অব্যাহতি পাচ্ছেন সে ব্যাপারে নজর রাখছে ওই গোয়েন্দা সংস্থা। কোনো সংসদ-সদস্য কোন প্রক্রিয়ায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন তা প্রতিবেদন আকারে ওপর মহলকে অবহিত করা হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়বস্তটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ব্যক্তি বা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ নয়। ব্যক্তির পরিচয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় কাজ করলে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হবে। দুদক রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক এমপিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে থাকলে দুদকের কাজ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে এবং আস্থার সংকট আরও ঘনীভূত হবে।