দাম বাড়ায় আমিষে টান, তেলাপিয়া পাঙ্গাশও উঠছে না গরিবের পাতে
ইয়াসিন রহমান
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১০:৫৯ পিএম
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে অস্থির মাছের বাজার। এদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে খুচরা বিক্রেতারা। দুয়ে মিলে নানা অজুহাতে ইচ্ছেমতো পকেট কাটছে ভোক্তার। এদের কারণে খুচরায় তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা। এই বাড়তি দামে অসহায় চাষির কোনো লাভ হচ্ছে না। তবে গরিবের পাত থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ। দামের কারণে তাদের আমিষে ধরেছে টান। সামর্থ্য না থাকায় খাবার তালিকা থেকে অনেক আগেই বাদ পড়েছে মাংস। আমিষের স্বাদ নিতে যারা মাছ কিনতেন তাদেরও মাথায় হাত পড়েছে।
চাষিরা বলছেন, পুকুরের জমি লিজের দাম, শ্রমিকের মজুরি এবং মাছের খাবারের দাম বেড়েছে। এরপরও চাষি পর্যায়ে মাছের দাম বেড়েছে খুবই কম। এর চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি দামে খুচরায় বিক্রি হচ্ছে। এটা করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা চাষিদের কাছ থেকে কম দামে কিনে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছে। খুচরা বিক্রেতারা বেশি দামে কিনে লাভসহ বিক্রি করায় দাম প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। পালটা অভিযোগ করছেন খুচরা বিক্রেতারা। তারা বলেন, চাষি পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় তারা নিরুপায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিশ ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হামিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, মাছের খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ, বিদ্যুৎ বিল ও মজুরি বাড়ার কারণে মূলত মাছের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। মাছের খাদ্যের মান ভালো না হওয়ার কারণেও উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তবে চাষি পর্যায়ে যে হারে দাম বেড়েছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা তার চেয়ে উচ্চদামে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করছেন। মাছ চাষ করে একজন চাষি কেজিতে ১০ টাকা লাভ করতে পারছেন না। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা একদিনের ব্যবধানেই কেজিতে ৪০-৫০ টাকা লাভ করছেন।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে নিু ও মধ্যবিত্তের হিমশিম খেতে হচ্ছে। যাদের আলুভর্তা ও ডিম-ডাল দিয়ে কোনোভাবে দুবেলা চলত, তারাও এখন প্রায় নিরুপায়। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের সেবার দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় খরচ বেড়েই চলেছে। কিন্তু আয় বাড়ছে না। এতে অধিকাংশ ভোক্তার সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাজারে ডিম, মুরগি ও তেলাপিয়া-পাঙ্গাশ এ তিন উৎস থেকে কিছুটা কম দামে প্রোটিন পাওয়া যেত। স্বল্পআয়ের মানুষ এ তিনটি থেকেই তাদের আমিষের চাহিদা পূরণ করতেন। এখন দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় একশ্রেণির ভোক্তার ভোগান্তি বাড়ছে।
রোববার রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, রামপুরা বাজার ও মালিবাগ কাঁচাবাজারে প্রতিকেজি পাঙ্গাশ ২২০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা পাঁচ মাস আগে ১৫০-১৭০ টাকা ছিল। আর বছর আগে ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তেলাপিয়া প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা। যা পাঁচ মাস আগে ১৮০ টাকা ছিল। রুই মাছ বিক্রি হয়েছে ৪৫০-৫০০ টাকা কেজি। যা আগে ৩৫০ টাকা ছিল। আইড় মাছ বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকা কেজি, আগে বিক্রি হয়েছে ৬০০-৬৫০ টাকা। দেশি ছোট চিংড়ি মাছ আটশ থেকে নয়শ টাকা কেজি। কাচকির গুঁড়া বিক্রি হয়েছে ৫০০-৬০০ টাকা কেজি। যা আগে ৪০০ টাকা ছিল।
নয়াবাজারে মাছ কিনতে এসেছেন আমেনা বেগম। বাজারে মাছের এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরছেন। কোথাও দাম জানতে চাইছেন। জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি তাঁতীবাজার এলাকায় পিঠা বিক্রি করি। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। দুই বছর আগে গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা হওয়ার পর থেকে কেনা বাদ দিয়েছি। কম দামে পাঙ্গাশ মাছ কিনতাম, সেগুলোও প্রতিকেজি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কীভাবে কিনব? বিক্রেতারা অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মন খারাপ করে চলে যাচ্ছি।
একই বাজারে খুচরা মাছ বিক্রেতা মো. সাগর বলেন, কয়েক মাস ধরে চাষি পর্যায়ে মাছের দাম অনেক বাড়তি। যে কারণে আড়তে দাম বেড়েছে। আর আমরা খুচরা বিক্রেতারা বেশি দামে এনে বেশি দামে বিক্রি করছি।
যশোরের ঝিকরগাছার মাছ চাষি মো. আলমগীর কবির যুগান্তরকে বলেন, কিছু কারণে মাছের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে বিঘাপ্রতি পুকুর লিজ নিতে ২০ হাজার টাকা বেড়েছে। শ্রমিকের মজুরি দিনে ৩০০ টাকা বাড়িয়ে দিতে হচ্ছে। এছাড়া মাছের খাবারের দাম প্রতি টনে ৩০ হাজার টাকা বেড়েছে। এসবের প্রভাব মাছের দামের ওপর পড়েছে। তবে চাষি পর্যায়ে যে দামে মাছ বিক্রি হচ্ছে, খুচরা পর্যায়ে তার তিনগুণ বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, চাষি পর্যায়ে প্রতিকেজি পাঙ্গাশ ও তেলাপিয় বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা, যা আগে ৯০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি রুই বিক্রি হচ্ছে ২২০-২২৭ টাকা। যা আগে ১৪০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি কই ১৭০ টাকা, যা আগে ১৩৬ টাকা ছিল। তবে দেখা যাচ্ছে, এসব মাছ খুচরা বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফিশ ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হামিদুল হক বলেন, এক কেজি ওজনের রুই মাছ তৈরি করতে সাধারণত প্রায় এক বছর লাগে। বর্তমানে চাষি পর্যায়ে এক কেজি ওজনের রুই মাছ ২২০-২২৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে এটি বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। যে কারণে চাষি এবং ভোক্তা উভয় ঠকছেন।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, সার্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই নিুআয়ের মানুষ কষ্টে আছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে নিত্যপণ্যের বাজারে পড়েছে। এতে উচ্চবিত্তের ভোগান্তি না হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নিুআয়ের মানুষ। তারা আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় চাহিদা মেটাতে পারছে না। ফলে কেনার সময় অনেকে পরিমাণে কম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে, যে পণ্যের দাম যা হওয়া উচিত সেগুলো মনিটর করা। তাতে অসাধুরা কারসাজি করতে পারবে না। এতে গরিবের উপকার হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সব ধরনের পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে অধিদপ্তর কাজ করছে। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। তারপরও বাজারে অভিযান পরিচালনা করে যৌক্তিক দামে পণ্য বিক্রি করার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মাছের বাজারেও অভিযান পরিচালনা করা হবে।